হিযরত কুরআন এবং হাদীসে বর্ণিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি এমন একটি বিষয় যা ইসলামের শুরুর দিকে একজন মুসলিম হওয়ার ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় রিকোয়ারমেন্ট হিসেবে পরিগনিত হতো। যখন মক্কা ছিল দারুল কুফর এবং মদীনা ছিল দারুল ঈমান, তখন হিযরত ছিল ঈমান ও কুফরের মধ্যকার স্পষ্ট পার্থক্যকারী। তখনকার দিনে হিযরত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
যদি তুমি আমাদের সাথে মদীনায় থাকো তবে তুমি আল্লাহর আউলিয়াদের মধ্য হতে একজন। আর তুমি যদি মক্কায় থাকো তবে তোমাকে নিরাপত্তা বা সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব থেকে আমরা মুক্ত এবং বিচার দিবসে তোমার হিসাব আল্লাহর হাতে।
একটা সময় পর্যন্ত হিযরত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু এরপর আমাদের আলিমরা এই বিষয়টি নিয়ে আর তেমন আলোচনায় যাননি। কারণ, তখন সবাই দারুল ঈমানেই অবস্থান করতো। তখন সবাই খিলাফাহর অধিনে ছিল। তারা এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কথা বলেননি কারণ তখনকার সময়ে এটা কোনো সমস্যা ছিল না। বর্তমানে আমরা যেমন দেখতে পাই যে—কেউ হয়তো ব্যবসায়-বাণিজ্য এমনকি দাওয়াহর স্বার্থে দারুল কুফরে গিয়ে বাস করছে; এরকমটা সেই সময় ছিলনা। তখনকার সময়ে এমন কেউ ছিল না যে আল্লার রাস্তায় দাওয়াহ দেওয়ার জন্য দারুল কুফরে গিয়ে বাস করবে। তারা দারুল কুফরে যেতো মুজাহিদ ফী সাবিলিল্লাহর পতাকাতলে। এমনটাই ছিল তখনকার অবস্থা। তাই আপনি খুব কম সংখ্যক ফকিহকেই পাবেন যারা হিযরত নিয়ে বেশি আলোচনা করেছেন। কারণ তারা তখনকার সমসাময়িক সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতেন, আলোচনা করতেন, আর হিযরত সেসবের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সকল মুসলিমই দারুল ইসলামে বাস করতো। অবশ্য এমন কিছু ঘটনা আছে যখন হিযরত নিয়ে আলোচনা হয়েছিল যেমন—যখন আল-আন্দালুসে মুসলিম শাসনের পতন ঘটলো এবং কিছু মুসলিম পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন। তখন আল-মাঘরিবের আলিমরা ফাতওয়া দিয়েছিলেন যে—যেসকল মুসলিম স্পেনে রয়ে গেছে তাদের স্পেন ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু এমন ঘটনা তখনকার সময়ে সচরাচর ঘটতো না। এমন কোনো ঘটনা ইমাম আবু হানীফা বা ইমাম শাফি’ঈ বা ইমাম মালিকের (রহি.) সময়ে ঘটেনি।
হিযরতের প্রকারভেদ:
দুই প্রকারের হিযরত রয়েছে। প্রথম প্রকার হলো নির্দিষ্ট সময়ের সকল মুসলিমের উপর বাধ্যতামূলক হিযরত। এই হিযরতের ব্যপারেই রাসুলুল্লাহ সা. বুখারী ও মুসলিমের একটি সহীহ হাদীসে বলেছেন,
حدثنا آدم بن أبي إياس، قال حدثنا شعبة، عن عبد الله بن أبي السفر، وإسماعيل، عن الشعبي، عن عبد الله بن عمرو ـ رضى الله عنهما ـ عن النبي صلى الله عليه وسلم قال ” المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده، والمهاجر من هجر ما نهى الله عنه “ قال أبو عبد الله وقال أبو معاوية حدثنا داود عن عامر قال سمعت عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم. وقال عبد الأعلى عن داود عن عامر عن عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم.
‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, সে-ই প্রকৃত মুসলিম, যার জিহ্বা ও হাত হতে সকল মুসলিম নিরাপদ এবং সে-ই প্রকৃত মুহাজির, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা যে ত্যাগ করে।[১]
অর্থাৎ, আপনি যদি আপনার হাত এবং আপনার জিহ্বা হতে অন্য মুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন তবেই আপনি প্রকৃতি মুসলিম। এবং সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুহাজির[২], যে এমন সকল কিছুকে ত্যাগ করে যা আল্লাহর অপছন্দ এবং তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। আমাদের সকলেরই উচিৎ সবসময় এই প্রকারের হিযরত করা; গুনাহ থেকে দাওয়াহর দিকে, আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে। রাসূল সা. বলছেন যে—একজন প্রকৃত মু’মিনের থেকে অন্যান্য লোকেরা এবং তাদের সম্পদ নিরাপদ। সে তাদের এবং তাদের সম্পদের কোনো ক্ষতি সাধন করে না। এবং একজন প্রকৃত মুহাজির হলো সে - যে জুনুব বা পাপ কাজ ত্যাগ করে। এরপর রাসূল সা. বলছেন— সর্বোত্তম হিজরত হলো সেসকল বিষয়গুলো ত্যাগ করা যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন। কারণ হিজরত শব্দটির অর্থ হলো - কোনো কিছুকে পরিত্যাগ করা, পেছনে ফেলে এগিয়ে চলা।
ইবনে হাযার (রহি.) বলেন,
হিযরত হলো দুই প্রকার। বাহ্যিক হিযরত এবং অভ্যন্তরিণ বা অন্তরের হিযরত।
অন্তরের হিযরত হলো - আপনি এমন কাজগুলো পরিত্যাগ করবেন যা আপনার আম্মারা-বিস-সু এবং শয়তান আপনাকে করতে বলবে। আর বাহ্যিক হিযরত হলো দ্বীনের জন্য একস্থান হতে অন্যত্র গমন করা।
এগুলো হলো সাধারণ হিযরত। কিন্তু আমরা নির্দিষ্ট করে বাহ্যিক হিযরত বিষয়ে আলোচনা করবো, যাকে ইবনে হাযার (রহি.) বলেন ‘আল-হিযরাহ বাহরা’। বাহ্যিক হিযরত বা দ্বীনের কারণে অন্যত্র গমন করার যে হিযরত সে বিষয়ে আমাদের আলোচনার মূলভিত্তি হবে কুরআনের আয়াত। কুরআন হলো আল-হুদা এবং আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি যার উল্লেখ কুরআনেই আছে। উত্তর যখন আল্লাহর কিতাবেই আছে তখন আর অন্যত্র খোঁজা কেন! আপনি যখন এই আয়াতগুলো শুনবেন বা পাঠ করবেন তখন আপনাকে অন্তর দিয়ে সেই আয়াতগুলো মর্ম বুঝতে হবে। আমরা এখানে হিযরতের ফিকহ্ বা এর হুকুম, হারাম, হালাল, মুবাহ্, মুস্তাহাব এসব নিয়ে আলোচনা করবো না। আমরা হিযরত সম্পর্কে আলোচনা করবো কুরআন ও রাসূলের (সা.) হাদীস থেকে। সুবহানাল্লাহ, হিযরত বিষয়ক আয়াতগুলো যদি আপনি অন্তর দিয়ে বোঝার চেষ্টা না করেন তবে আপনি কখনোই এর মর্মোদ্ধার করতে পারবেন না। এবং কুরআনকে আমাদের এভাবেই বোঝা উচিত। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা বলেন-
إِنَّ فِى ذٰلِكَ لَذِكْرٰى لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ
নিশ্চয়ই এতে উপদেশ রয়েছে তাদের জন্য যাদের অন্তর আছে বা যারা নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করে। [ক্বা-ফ : ৩৭]
এতে উপদেশ রয়েছে কাদের জন্য?
لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلْبٌ
যাদের অন্তর আছে।
যদি আপনার অন্তর না থাকে, আপনি কুরআন শুধু পড়ার জন্য পড়ছেন, একে অন্তর দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন না; তাহলে কুরআন আপনার কোনো উপকারে আসবে না। কারণ আল্লাহ আযযা ওয়াযাল বলেন - উপদেশ সবার জন্য নয়। উপদেশ শুধু তাদের জন্য যাদের অন্তর আছে।
أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ
অথবা যারা নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করে।
কুরআন শুধুমাত্র এসকল লোকেদের উপকারে আসবে। আল্লাহ বলেন,
وَلَا يَزِيدُ الظّٰلِمِينَ إِلَّا خَسَارًا
কিন্তু তা (কুরআন) যালিমদের ক্ষতি-ই বৃদ্ধি করে। [আল-ইসরা : ৮২]
কুরআন যালিমদের কোনো উপকারে তো আসবেই না বরং তাদের ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দেবে। কুরআন হলো আল-ফুরকান। ফুরকান মানে হলো - যা কোনো কিছুকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়, দুই ভাগে ভাগ করে দেয়, পার্থক্য তৈরি করে। কুরআনের কাজও এমন। কুরআন মানবজাতিকে দুটি দলে ভাগ করে দেয়। একদল যাবে আর-রহমানের দিকে এবং অন্য দলটি যাবে আশ-শাইত্বনের দিকে। এটাই কুরআনের কাজ। আল্লাহ কুরআনে সালিহ (আ.) সম্পর্কে বলেন যে তাকে পাঠানোর আগে লোকেরা একত্রিত ছিল।
فَإِذَا هُمْ فَرِيقَانِ يَخْتَصِمُونَ
....অতঃপর তারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে ঝগড়া করছিল। [আন-নামাল : ৪৫]
কিন্তু তাদের মধ্যে যখন সালিহকে (আ.) পাঠানো হলো তখন তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়ে গেল।
আপনি যখন হিযরত সম্পর্কিত আয়াতগুলো অধ্যায়ন করবেন তখন আপনাকে তা আন্তরিক ভাবেই করতে হবে। কারণ হিযরত একটি জটিল বিষয়। এটি রাসূলুল্লাহর (সা.) সময়ও জটিল ছিল এবং এখনও জটিল আছে। আজ অনেক মুসলিমই হিযরত করতে চায়। কারণ তারা এমন কোথাও হিযরত করতে চায় যেখানে তার আয় বৃদ্ধি পাবে। তারা বলে - আরে আমিও তো হিযরত ফী সাবিলিল্লাহ্ করতে চাই কিন্তু আমি এ-ও চাই যে আমার আয় বাড়বে, আমি বাড়ি করবো, সম্পদ বাড়াবো। কিন্তু সাহাবাদের হিযরত মোটেও এমন ছিল না। হিযরত করার জন্য তাদের কেউ কেউ সম্পদের সিংহভাগ আবার কেউ কেউ সমস্ত সম্পদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। রাসূল (সা.) বা সাহাবা (রা.) কারও জন্যই হিযরত সহজ ছিল না। হিযরত তখনও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এবং আজও ঝুঁকিপূর্ণ।
আমরা শুরু করবো সূরা নিসা দিয়ে। হিযরতের প্রসঙ্গে সূরা নিসার ৪টি আয়াত নাযিল হয়েছে। আলোচনা শুরুর পূর্বে আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পটভূমি সম্পর্কে একটু সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নিই।
হিযরত যখন ওয়াজিব এবং ফরয হয়ে গিয়েছিল তখনও কিছু মুসলিম মদীনায় হিযরত না করে মক্কায় থেকে গিয়েছিল। এরপর যখন কুরাইশ বাহিনী বদর অভিমুখে যাত্রা শুরু করলো তখন ঐ মুসলিমরাও তাদের সাথে যোগ দিলো। আমেরিকান সেনাবাহিনীর মুসলিম সৈন্যদেরকে যেমন মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুখোমুখি হতে হয় তখন ঐ মুসলিমদের অবস্থাও তেমন হয়েছিল, যখন তারা রাসূলের সা. বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল। এসকল মুসলিমদের সম্পর্কেই যে এই আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে সেই বিষয়ে বুখারীর একটি হাদীসে বর্ণিত আছে। কুরাইশদের সাথে বের হওয়ার সময় হয়তো মুসলিমদেরকে আক্রমণ করার ইচ্ছা তারা পোষণ করেনি, যেমনটা আমেরিকান সেনাবাহিনীর মুসলিম সৈন্যরাও অন্য মুসলিমদের আক্রমণ করার ইচ্ছা পোষণ করে না। বর্ণনায় আছে যে মুসলিমদের তীর অমুক এবং অমুককে আঘাত করেছে কিন্তু তারা মুসলিমদেরকে আক্রমণ করার ইচ্ছা নিয়ে আসেনি। তারা নীরবে শুধুমাত্র কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে এসেছিল। এরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু তবুও তাদের কেউ কেউ মুসলিমদের আঘাতে নিহত হয়েছিল। এসকল লোকেদের ব্যাপারেই এই আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল।
আল্লাহ আযযা ওয়াযাল বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ تَوَفّٰىهُمُ الْمَلٰٓئِكَةُ ظَالِمِىٓ أَنفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنتُمْ ۖ
নিশ্চয়ই যারা নিজেদের প্রতি যুলুমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে?’ [আন-নিসা : ৯৭]
এসকল লোককে আল্লাহ আযযা ওয়াযাল যুলুমকারী (ظَالِمِىٓ) বলে অভিহিত করেছেন। এরা কাদের সাথে যুলুম করেছে? এরা নিজেদের সাথেই যুলুম করেছে, অত্যাচার করেছে। আমরা জানি জান কবজ করার দায়িত্বে ফেরেশতারা থাকেন। তো ফেরেশতারা যখন এদের জান কবজ করতে আসলো তখন তারা (ফেরেশতারা) নীরবে তাদের জান কবজ করলো না। ফেরেশতারা তখন তাদেরকে প্রশ্ন করলো -
فِيمَ كُنتُمْ؟
তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? কোথায় ছিলে? কি করছিলে? তোমরা তো কুরাইশদের সাথে ছিলে। তোমরা তো মক্কায় বাস করছিলে। যখন মদীনায় হিযরত করার সুযোগ ছিল তখন তোমরা কি করছিলে?
অর্থাৎ, ফেরেশতারা এই প্রশ্ন করার জন্য বিচার দিবস পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না, এমনকি এই প্রশ্ন করার জন্য কবর পর্যন্তও অপেক্ষা করবে না। ফেরেশতারা সেই মুহূর্তেই তাদের জান কবজ করার সময়ই এই প্রশ্ন করবে - তোমরা কোথায় ছিলে? এটি এমন এক প্রশ্ন যা করার জন্য দেরি করা যাবে না, অপেক্ষা করা যাবে না। ঐ লোকেরাও উত্তর দিবে -
قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِى الْأَرْضِ ۚ
তারা বলে, ‘আমরা যমীনে দূর্বল ছিলাম।’ [আন-নিসা : ৯৭]
তারা বলবে - আমরা তো দূর্বল ছিলাম। ভাই দূর্বল হওয়াতে কোনো সমস্যা নেই, যদি আপনার কাছে কোনো বিকল্প না থাকে। রাসূল (সা.) এবং সাহাবাগণ এমন অবস্থায় ১৩ বছর ছিলেন। তারা ছিলেন ‘মুসতাদআফীন’। তারা ছিলেন মক্কার দূর্বলতম দল। কিন্তু যখনই আপনি কোনো বিকল্প উপায় পেয়ে যাবেন তখন ঐ স্থান ত্যাগ করা আপনার জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে। যখন আপনি অন্য কোথাও সম্মানের সাথে থাকতে পারছেন তখন পূর্বের স্থানে থেকে হেয় হওয়ার কোনো মানে নেই। যখন আপনার সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই তখন সবর করা উত্তম। কিন্তু বিকল্প পথ যখন আপনার সামনেই রয়েছে তবুও আপনি হিযরত করছেন না দুটি কারণে - সম্পদের ক্ষতি হবার ভয় এবং অনিরাপত্তার ভয়, তখন আপনি নিজের উপর নিজেই যুলুম করছেন।
قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِى الْأَرْضِ ۚ
আমরা যমীনে দূর্বল ছিলাম।
আপনি তাদের উত্তরে দূর্বলতার ছাপ দেখতে পাবেন। সুবহানাল্লাহ! তাদেরও একই অবস্থা, বিকল্প থাকা সত্ত্বেও যারা কুফফারদের মধ্যে বাস করে। এজন্য কুফফারদের মাঝে বাস করা বিষয়ক ফিকহ্ও দূর্বল হয়ে পরেছে। আপনি যখন কুফফারদের মাঝে বাস করবেন তখন ঐ পরিস্থিতি ফিকহে্র উপর প্রতিফলিত হবে। এজন্যই আপনি এমন ফাতওয়া শুনতে পান যে, বোনদের আর হিজাব পরিধান করতে হবে না, কুফফারদের সেনাবাহিনীতে যেসকল মুসলিম আছে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে, আপনি রিবা বা সূদে বাড়ি কিনতে পারবেন ইত্যাদি। সম্পূর্ণ ফিকহ্ই দূর্বল হয়ে পড়ে। এজন্যই আছে ফিকহ্ মুসতাদআফ বা দূর্বলদের ফিকহ্। তাই আপনি এমন এমন বিধান শুনতে পান যা দূর্বল হওয়াকে জাস্টিফাই করে। এরপর যখন কুফফারদের বিদ্বেষের বেড়ি আপনার গলায় জড়িয়ে যায় তখন আপনি বলেন যে ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম সংযমের ধর্ম। এসব বুলি না আওড়িয়ে আপনার বরং কুফফারদের বেড়ি থেকে মুক্ত হয়ে আসা উচিত। হ্যাঁ, ইসলাম অবশ্যই শান্তির ধর্ম। কিন্তু একইসাথে ইসলাম ন্যায়েরও ধর্ম। তাই সবসময় শুধু এটা বললেই চলবে না যে ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম সংযমের ধর্ম। আপনাকে অনেক সময় এ-ও বলতে হবে যে ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম। সঠিক সময়ে সঠিক কথাটাই বলতে হবে। সুতরাং, কুফফারদের মাঝে বসবাসকারী মুসলিমদের সংস্কৃতিটাই দূর্বল হয়ে পড়ে।
قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِى الْأَرْضِ ۚ
আমরা যমীনে দূর্বল ছিলাম।
এরপর ফেরেশতারা কি বললো?
قَالُوٓا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وٰسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا ۚ
ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিযরত করতে?’ [আন-নিসা : ৯৭]
ঐ লোকেদের অযুহাত গ্রহনযোগ্য নয় যারা বলে যে তারা দূর্বল ছিল। যাহোক, আমি আবারও বলতে চাই যে আমরা এখানে হিযরতের আহকাম নিয়ে আলোচনা করছি না। কারণ পরিস্থিতি ভিন্ন হলে হিযরতের কিছু হুকুম জারি করা অন্যায্য হয়ে পড়ে। আগের পরিস্থিতি এমন ছিল যে—মক্কা ছিল স্পষ্টত দারুল কুফর এবং মদীনা ছিল স্পষ্টত দারুল ঈমান। তাই তখন হিযরত ছিল ফরয। এখন আমাদের দারুল কুফর আছে কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠ দারুল ঈমান নিয়ে একটু সমস্যা আছে। তাই এখন হিযরতের হুকুম তখনকার মতে এত সোজাসাপটা নয়। আমরা সাধারণ হিযরত প্রসঙ্গে কথা বলছি। এখন হিযরতের হুকুম ব্যক্তিভেদে বা এক স্থানকাল ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, আমি মনে করি যে আমেরিকায় ৯/১১ পূর্ববর্তী এবং ৯/১১ পরবর্তী সময়ে হিযরতের হুকুমে ভিন্নতা রয়েছে। আগে আমেরিকার প্রায় সকল জায়গাই দাওয়াহর জন্য উন্মুক্ত ছিল কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমরা হিযরত নিয়ে আলোচনা করছি যেন মুসলিমরা বুঝতে পারে যে হিযরত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হিযরতের আয়াতগুলো আন্তরিকভাবে নিতে হবে এবং যদি শর্তগুলো আপনার পরিস্থিতির সাথে মিলে যায় তবে আপনাকেও হিযরতের রাস্তা খুঁজতে হবে।
أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وٰسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا ۚ
আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিযরত করতে?
আল্লাহ এই বিশাল পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এতে ৫টি মহাদেশ আছে। তবুও কি তোমরা হিযরত করার মতো জায়গা খুজে পেলে না? তোমরা কেন মক্কায় রয়ে গেলে এবং শেষমেশ কুরাইশদের সাথে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বদরে উপস্থিত হলে যখন মদীনা ছিল মাত্র কয়েকশ কিলোমিটার দূরে? যার মনে তাকওয়া আছে তার জন্য আল্লাহ কোনো না কোনো রাস্তা বের করে দেবেন।
وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُۥ مَخْرَجًا
যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। [আত-তালাক্ব : ০২]
وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ۚ
এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দান করবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। [আত-তালাক্ব : ০৩]
আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আপনি যদি কল্পনা করতে পারতেন তাহলে তো তা কোনো পরীক্ষাই হলো না। আল্লাহ এর মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন আপনি আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন কি না।
তো ঐসব লোকেদের পরিণাম কি হবে? আল্লাহ বলেন,
فَأُولٰٓئِكَ مَأْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ ۖ
সুতরাং তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। [আন-নিসা : ৯৭]
যারা হিযরত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদের গন্তব্য হলো জাহান্নাম। তারা দুনিয়ায় অসম্মান বরণ করে নিয়েছে এবং আখিরাতেও তারা অসম্মানিত হবে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম আছে। আল্লাহ বলেন,
إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَآءِ وَالْوِلْدٰنِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا
তবে যেসকল পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও খুজে পায় না (তাদের কথা ভিন্ন)। [আন-নিসা : ৯৮]
এই বিষয়টি আমাদের ঠিকভাবে বুঝতে হবে। কারণ অনেকে হয়তে বলতে পারে - আমি হিযরত করতে পারছি না। অথচ তার হিযরত করতে না পারার পেছনে কারণ হলো রিযকের ভয় ও অনিরাপত্তার ভয়। এই ধরনের অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা জানি রাসূলের (সা.) সময় যারা হিযরত করেছেন তাদের প্রত্যেকেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। মক্কার মুহাজিররা তাদের সম্পদ ফেলে এসেছিলেন। তাই প্রত্যেকের জন্যই ঝুঁকিটা ছিল বড় মাত্রার। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো তারা, যাদের পক্ষে হিযরত করা একেবারেই অসম্ভব, যারা অপারগ। তাদের ব্যপারে আল্লাহ বলেন,
فَأُولٰٓئِكَ عَسَى اللَّهُ أَن يَعْفُوَ عَنْهُمْ ۚ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا
অতঃপর আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল। [আন-নিসা : ৯৯]
যেসব বিষয় মানুষকে হিযরত থেকে বিরত রাখে:
দু’টি বিষয় মানুষকে হিযরত করা থেকে বিরত রাখে। সেগুলো হলো -
১. নিরাপত্তা
২. রিযক
আপনারা জানেন যে একস্থানে অনেকদিন যাবৎ থাকলে সেখানকার মানুষের সাথে আপনার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠবে, আপনার স্ত্রীরও হয়তো বান্ধবী থাকবে, আপনি সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আপনার বাচ্চাদের স্কুলে লেখাপড়ায় ভালো অগ্রগতি হচ্ছে। এমন অবস্থায় আপনি সেই স্থান ত্যাগ করছেন, সেখান থেকে মূলোৎপাটন করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। তখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে - আমাদেরকে কি নতুন জায়গায় আগন্তুক হিসেবে দেখা হবে? আমার স্ত্রী সাথে কি কেউ কথা বলতে আসবে নাকি সে সারাদিন বাসায় একলা বসে থাকবে? আমার বাচ্চাগুলোকেও কি আগন্তুক হিসেবে দেখা হবে নাকি তাদের কোনো নতুন বন্ধু হবে? আমি কীভাবে আয়-রোজগার করবো? কীভাবে চলবো? ইত্যাদি। আল্লাহজানেন যে মুহাজিরের মনে এমনসব প্রশ্ন জাগে। তাই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ এই ব্যপারে আপনাকে বলছেন,
وَمَن يُهَاجِرْ فِى سَبِيلِ اللَّهِ يَجِدْ فِى الْأَرْضِ مُرٰغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً ۚ وَمَن يَخْرُجْ مِنۢ بَيْتِهِۦ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُۥ عَلَى اللَّهِ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
আর যে আল্লাহর রাস্তায় হিযরত করবে, সে যমীনে বহু আশ্রয়স্থল ও সচ্ছলতা লাভ করবে। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হয়ে বের হয় অতঃপর (সে অবস্থায়) তার মৃত্যু ঘটলে তার প্রতিদান আল্লাহর উপর অবধারিত হয়। বস্তুতঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
অর্থাৎ, যে আল্লাহর রাস্তায় গৃহত্যাগ করবে বা হিযরত করবে - সম্পদের জন্য নয়, এমনকি সেই হাদীসটি অনুসারে যেখানে বলা হয় এমন কারও জন্য যাকে আপনি বিয়ে করতে চান, সেজন্যও নয়, শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। হিযরত ফী সাবিলিল্লাহ্। যে আল্লাহর রাস্তায় গৃহ ত্যাগ করবে সে লাভ করবে (مُرٰغَمًا) মুরাগামান। মুরাগামান কী? মুফাসসিরগণ বলেন ‘মুরাগাম’ মানে হলো ‘মান’আ’ বা নিরাপত্তা। মুরাগামান বলতে আরো বোঝায় গা ঢাকা দেয়ার বা পলায়ন করার স্থান। ধরুন শত্রু আপনার পিছনে ধাওয়া করছে, এমতাবস্থায় আপনি শত্রুর চোখ এড়াতে কোনো স্থানে পলায়ন করলে তাকেও মুরাগামান বলা হয়। পৃথিবী অনেক বড়। আপনি শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য, আল্লাহর আ’দু বা শত্রুর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যত্র পলায়ন করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তারা মক্কায় আপনাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, তাহলে যান, মদীনায় গিয়ে মুরাগামান-এর খোঁজ করুন। এই আয়াতে সেই কথাই বলা হচ্ছে - শত্রুরা যদি আপনাকে এক জায়গায় কোণঠাসা করে ফেলে তবে আপনি অন্যত্র মুরাগামান লাভ করবেন, নিরাপত্তা লাভ করবেন যদি আপনি খোঁজ করেন। রাসূলের (সা.) জন্য এই বিষয়টি মোটেও সহজ কিছু ছিল না। তিনি কয়েক বছর যাবৎ এমন জায়গার খোঁজ করেছেন যেখানে তিনি নিরাপত্তা লাভ করতে পারবেন। এবং পরবর্তীতে আল্লাহ আযযা ওয়াযাল তাকে এমন জায়গার দিশা দিলেন - মদীনা। কিন্তু এই দিশা পাওয়ার পিছনে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল। অনেকসময় আমরা একেবারে কিছু না করেই কোনো একটি সমস্যার সমাধান পেতে চাই। না, এভাবে সমাধান মিলবে না। প্রথম পদক্ষেপটি আপনাকেই নিতে হবে। কারণ আমরা এক হাদীসে কুদসী থেকে জানি যে, আপনি যদি আল্লাহ আযযা ওয়াযালের দিকে হেঁটে অগ্রসর হন তবে আল্লাহ আপনার দিকে দৌড়িয়ে অগ্রসর হবেন। আপনি যদি আল্লাহ আযযা ওয়াযালের দিকে এক পা অগ্রসর হন তবে আল্লাহ আপনার দিকে কয়েক পা অগ্রসর হবেন। কিন্তু শুরুটা আপনাকেই করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপটা আপনাকেই নিতে হবে এবং আপনার জন্য বাকীটা আল্লাহ আযযা ওয়াযাল করে দিবেন।
মুরাগামান কাসীরান ওয়াসাআ’হ (مُرٰغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً)। ‘সাআ’হ’ (سَعَةً) মানে কী? মুফাসসিরগণ বলেন ‘সাআ’হ’ মানে হলো রিযক। সুতরাং, যে দুটো বিষয় নিয়ে আপনার চিন্তা ছিল—রিযক ও নিরাপত্তা—আল্লাহ আযযা ওয়াযাল আপনাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি আপনাকে সেগুলো দান করবেন।
হিযরতকে তুলনা করা যায় একটি গভীর খাদের কিনারা থেকে লাফ দেওয়ার সাথে। আপনি আল্লাহ উপর বিশ্বাস রেখে লাফ দিবেন কিন্তু খাদের তলদেশে কি আছে তা দেখার অনুমতি আপনার নেই। খাদের নিচে কি পানি না পাথর তা আপনি দেখতে পারবেন না। কিন্তু লাফ আপনাকে দিতেই হবে। আপনি আল্লাহর উপর আপনার সমস্ত বিশ্বাস স্থাপন করবেন এবং খাদের কিনারা থেকে লাফ দেবেন—এটাই হিযরত। আল্লাহর উপর আপনার বিশ্বাস রাখতে হবে। আল্লাহ আপনাকে আশ্বস্ত করেছেন যে তিনি আপনাকে মুরাগাম এবং সাআ’হ দান করবেন। যদিও হিযরতকে মোটেও সহজ বলে মনে হয় না তবুও আল্লাহ আপনাকে এগুলো দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এরপর আল্লাহ বলছেন,
وَمَن يَخْرُجْ مِنۢ بَيْتِهِۦ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُۥ عَلَى اللَّهِ ۗ
যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগী হয়ে বের হয় অতঃপর (সে অবস্থায়) তার মৃত্যু ঘটলে তার প্রতিদান আল্লাহর উপর অবধারিত হয়।
দেখুন আল্লাহ আপনাকে মৃত্যু থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না। কারণ আপনি হিযরত করুন বা না করুন, যেকোনো অবস্থাতেই আপনি মৃত্যুবরণ করতে পারেন। আল্লাহ আপনাকে মৃত্যু থেকে নিরাপত্তা দানের ওয়াদা করবেন না। আপনার মৃত্যু যদি চলেই আসে, তাতে আপনি মক্কায় থেকে যান বা মদীনায় হিযরত করুন, আপনার মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু আল্লাহ আপনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে আপনি যদি হিযরত করেন তবে তার আযর বা সাওয়াব আপনি লাভ করবেন।
ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُۥ عَلَى اللَّهِ ۗ
অর্থাৎ, আপনি যদি সম্পূর্ণ যাত্রা সম্পন্ন না-ও করেন তবুও আপনি হিযরতের সম্পূর্ণ আযর বা সাওয়াব লাভ করবেন। সুতরাং, আপনাকে দুটি বিষয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে এবং একটি বিষয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে না। আপনি মৃত্যু হতে নিরাপত্তা লাভ করবেন না। কিন্তু আপনি রিযক এবং শত্রুর হাত থেকে মান‘আ বা নিরাপত্তা লাভ করবেন। শত্রুর থেকে পলায়ন করার মতো একটি জায়গার সন্ধান পাবেন। আল্লাহর এই পৃথিবী হিযরত করার জন্য যথেষ্ট বড়। আম্বীয়া আলাইহিমুস সালামগণও হিযরত করেছিলেন। মূসা (আ.) হিযরত করেছিলেন। যখন তিনি ফিলিস্তিনে পৌছলেন তখন মাদইয়ানের লোকটি তাঁকে কি বলেছিল?
نَجَوْتَ مِنَ الْقَوْمِ الظّٰلِمِينَ
ভয় কোরো না, এখানে তুমি যালিম সম্প্রদায় হতে নিরাপদ। [আল-কাসাস : ২৫]
এবং যখন রাসূল সা. হিযরত করে মদীনায় গেলেন তখন সেখানকার লোকেরাও একই কথা বলেছিল,
এখানে আপনি যালিম সম্প্রদায় হতে নিরাপদ। আমরা আপনাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সেভাবেই লড়াই করবো যেভাবে আমরা আমাদের পরিবারের সুরক্ষার জন্য লড়াই করে থাকি।
আপনি তখনকার মুহাজিরদের দেখুন বা আজকের মুহাজিরদের, সবসময়ই দেখবেন তাদের প্রচেষ্টায় আল্লাহ বারাকাহ দান করেন। আল্লাহ তাদের রিযকের ব্যবস্থা করে দেন এবং শত্রুদের হাত থেকে নিরাপত্তা দেন।
আল্লাহ আরও বলেন,
وَالَّذِينَ هَاجَرُوا فِى اللَّهِ مِنۢ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِى الدُّنْيَا حَسَنَةً ۖ وَلَأَجْرُ الْءَاخِرَةِ أَكْبَرُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
যারা হিযরত করেছে আল্লাহর রাস্তায় অত্যাচারিত হওয়ার পর, আমি অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়াতে উত্তম আবাস দান করবো। আর আখিরাতের প্রতিদান তো বিশাল, যদি তারা জানতো। [আন-নাহল : ৪১]
অর্থাৎ, আল্লাহ আপনাকে এই দুনিয়াতে হাসানাহ দান করবেন এবং অখিরাতে আরো উত্তম পুরস্কার দান করবেন। ইবনে কাসীর (রহি.) বলেন—ইবনে আব্বাস (রা.), আশ-শাবি (রহি.), কাতাদাহ (রহি.) বলেন - এখানে হাসানাহ মানে হলো মদীনা। এবং অন্যান্যরা যেমন মুজাহিদ (রহি.) বলেন, এখানে হাসানাহ মানে হলো ‘রিযক তাইয়্যিব’ বা বিশুদ্ধ রিযক। আল্লাহ আপনাকে বিশুদ্ধ রিযক দান করবেন। আল্লাহ এখানে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না যে এই রিযক পরিমাণে বেশি হবে। রিযক কম বা বেশি যেকোনো পরিমানে হতে পারে কিন্তু নিঃসন্দেহে তা হবে তাইয়্যিব বা বিশুদ্ধ। হতে পারে আপনার সম্পদ পরিমাণে কম কিন্তু এতে বারাকাহ রয়েছে, কিন্তু অন্য কারও সম্পদ হয়তো পরিমাণে অধিক কিন্তু এতে কোনো বারাকাহ নেই। অর্থাৎ এখানে ইস্যুটা পরিমাণ নিয়ে নয়, বরং ইস্যুটা হলো এতে বারাকাহ আছে কি নেই তা নিয়ে। ইবনে কাসীর এই বিষয়টি নিয়ে বলেন, এই আয়াতে যে মুহাজিরদের কথা বলা হচ্ছে তারা তাদের বাসস্থান ত্যাগ করে এসেছেন, তাই তারা যা ত্যাগ করে এসেছেন আল্লাহ তাদেরকে তার চেয়েও উত্তম কিছু দান করেছেন। আপনি যদি আল্লাহর জন্য কিছু ত্যাগ করেন তবে আল্লাহ তার চেয়েও উত্তম কিছু আপনাকে দান করবেন। আল্লাহ এই মুহাজিরদের ক্ষমতা দিয়েছেন, তাদের কেউ হয়েছেন নেতা কেউবা বিচারক, তাদের প্রত্যেককেই আল্লাহ মুত্তাকীদের ইমাম করেছেন। মক্কায় এই মুহাজিরদের সম্পদ ছিল সীমিত, তারা যদি মক্কাতেই থাকতেন এবং সেখানেই মারা যেতেন তাহলে কেউ হয়তো তাদেরকে চিনতোও না, তাদের নামও শুনতো না। হঠাৎ করেই তারা সারা মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক বনে গেলেন, তারাই হয়ে গেলেন আলোর মশালবাহক, যে আলো এই মানবজাতিকে নিয়ে যাবে জান্নাতের দিকে। এরাই মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত করেছিলেন রিক্তহস্তে, আর এখন এদের কেউ ইরাকের আমির কেউবা মিশরের আমির; এভাবেই তারা ইসলামের দাওয়াহর জন্য ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। তারা যা বিসর্জন দিয়ে এসেছেন আল্লাহ আযযা ওয়াযাল তার চেয়ে উত্তম জিনিস তাদেরকে দান করেছেন। আল্লাহ বলেছেন তাদের আখিরাতের প্রতিদান তো আরও বিশাল। উমার বিন খাত্তাব (রা.) যখন মুসলিমদের মাঝে গনিমাহ বণ্টন করতেন তখন বলতেন,
এই নাও, আল্লাহ তোমাদের এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং আখিরাতের প্রতিদান তো বিশাল।
এ সবকিছুই হলো হিযরতের বারাকাহ।
হিযরত কেন করবেন?
প্রথম কারণ:
হিযরত করবেন কারণ তা রাসূলের সা. আদেশ। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,
তোমাদের জন্য আমার ৫টি আদেশ রয়েছে। ১. শোনো, ২. মেনে নাও, ৩. সবসময় জামাআতবদ্ধ থাকবে, ৪. হিযরত এবং ৫. জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্।[৩]
এগুলো হলো উম্মাহর জন্য রাসূলের (সা.) ৫টি আদেশ। দেখুন এগুলোই কিন্তু একটি সফল জামাআতের মৌলিক উপাদান, যারা আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবে। শোনো এবং মেনে নাও - এ থেকে বোঝা যায় যে সবসময়ই একজন আমির থাকবেন এবং একটি জামাআত থাকবে। জামাআত - কোনো দলের অংশ হওয়া এবং একলা না থাকা। সবাই যখন আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালায় তখন তাতে কোনো বারাকাহ পাওয়া যায় না। কিন্তু যখন সকলে মিলে একটি জামাআত হিসেবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালায় তখনই আল্লাহ তাতে বারাকাহ দান করেন। এরপর হিযরত এবং জিহাদ। আপনি বেশিরভাগ সময়ই দেখবেন হিযরত এবং জিহাদের কথা একই সাথে বলা হয়ে থাকে। কারণ, অনেক সময়ই হিযরত জিহাদের একটি পূর্বশর্ত হওয়ার দাবি রাখে। অর্থাৎ, জিহাদ করতে হলে আপনাকে আগে হিযরত করতে হবে। এই দুটি বিষয় পরস্পর সম্পর্কিত। কিছু আয়াতে পরস্পর সম্পর্কিত তিনটি বিষয়ে উল্লেখ আছে—ঈমান, হিযরত এবং জিহাদ। সুতরাং, এগুলো প্রতিটির সাথে প্রতিটির যোগসূত্র আছে।
এখানে হিযরতের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা সাময়িক নয়। বরং এই আদেশ কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। কারণ রাসূল (সা.) বলেন,
যতদিন জিহাদ থাকবে ততদিন হিযরত থাকবে।
তিনি (সা.) আরও বলেন,
যতদিন লড়াই করার মতো আল্লাহর শত্রু অবশিষ্ট থাকবে ততদিন হিযরত থাকবে।
আল্লাহর শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আপনাকে হিযরত করতে হবে। মক্কা থেকে মদীনায় হিযরতের উদ্দেশ্য ছিল জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্। মদীনা ছিল মুজাহিদদের ঘাঁটি, যেখানে তারা জিহাদের প্রস্তুতি নিতেন।
দ্বিতীয় কারণ:
মুশরিকদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য, মুশরিকদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য হিযরত করবেন। রাসূল সা. বলেন,
أنا بريءٌ من كلِّ مسلمٍ يقيم بين أظهر المشركين
আমি এমন সকল মুসলিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম যারা মুশরিকদের ভূমিতে বাস করে।[৪]
আরেক বর্ণনায় রাসূল (সা.) বলেন,
আমি এমন সকল মুসলিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম যারা মুশরিকদের ভূমিতে বাস করে। তাদের উচিত নয় একে অপরের ঘরের আলো দেখা।রাসুলুল্লাহ সা. আপনাকে মুশরিকদের থেকে এতটাই দূরে অবস্থান করতে বলছেন যাতে করে আপনি তাদের ঘরের বাতির আলো পর্যন্ত দেখতে না পান।
রাসূল (সা.) বলেন,
যে মুশরিকদের মধ্যে বাস করে, সে তাদের মধ্য হতেই একজন।
যারির (রা.) রাসূলের (সা.) কাছে বাইয়াত দিতে এসে বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনার হাত বাড়িয়ে দিন যাতে আমি বাইয়াত দিতে পারি এবং আপনার শর্তগুলো আমাকে বলুন।” তখন রাসূল (সা.) বললেন, “বাইয়াত হলো যে তুমি আল্লাহর আনুগত্য করবে, সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, মুসলিমদের নাসীহাহ বা উপদেশ দিবে এবং মুশরিকদের ত্যাগ করবে।” যারিরের (রা.) থেকে রাসূল (সা.) যে বাইয়াত নিয়েছিলেন তার একটি অংশ ছিল মুশরিকদের ত্যাগ করা।
তৃতীয় কারণ:
হিযরতের আযর বা সাওয়াব লাভের জন্য হিযরত করবেন। রাসূল (সা.) এক হাদীসে বলেন,
শয়তান আদম সন্তানের রাস্তাসমূহে বসে থাকে। সে ইসলামের পথে বসে (বাধা সৃষ্টি করতে গিয়ে) বলে, তুমি ইসলাম গ্রহণ করবে আর তোমার ধর্ম ও তোমার বাপদাদার ধর্ম এবং তোমার পিতার পূর্বপুরুষদের ধর্ম পরিত্যাগ করবে? কিন্তু আদম সন্তান তার কথা অমান্য করে ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর শয়তান তার হিযরতের রাস্তায় বসে বলে, তুমি হিযরত করবে? তোমার ভূমি ও আকাশ পরিত্যাগ করবে? মুহাজির তো একটি লম্বা রশিতে আবদ্ধ ঘোড়ার মতো (নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে বাধ্য)। কিন্তু সে ব্যক্তি তার কথা অমান্য করে হিযরত করে। এরপর শয়তান তার জিহাদের রাস্তায় বসে এবং বলে, তুমি কি জিহাদ করবে? এ-তো নিজেকে এবং নিজের ধনসম্পদকে ধ্বংস করার নামান্তর। তুমি যুদ্ধ করে নিহত হবে, তোমার স্ত্রী অন্যকে বিবাহ করবে, তোমার সম্পদ ভাগ হবে। সে ব্যক্তি তাকে অমান্য করে জিহাদে গমন করে। রাসূল সা. বলেন, যে এরূপ করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো মহান আল্লাহর (ওয়াদা অনুযায়ী জান্নাত তার) ওপর হক। আর যে শহীদ হয়, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর ওপর হক। যদি সে ডুবে যায়, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর উপর অবধারিত। আর যদি তার বাহন তাকে ফেলে দিয়ে তার গর্দান ভেঙে দেয় বা মেরে ফেলে, তখনও তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর উপর অবধারিত।[৫]
অর্থাৎ, এই লোকের সাথে যা-ই ঘটুক না কেন আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যদি সে তিনটি বিষয়ে শয়তানকে অমান্য করে—ইসলাম, হিযরত, জিহাদ। একটি খুবই চমকপ্রদ হাদীসে রাসূল সা. বলেন,
যদি কেউ হিযরত করা অবস্থায় মারা যায় তাহলে ঐ ব্যক্তির জন্মের স্থান হতে তার মৃত্যুর স্থান পর্যন্ত জায়গা পরিমাপ করা হবে এবং তাকে জান্নাতে এর সমপরিমাণ জায়গা দেওয়া হবে।সুবহানাল্লাহ! কি চমৎকার একটি হাদীস। আমাদের মধ্যে যারা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দূরবর্তী জায়গা থেকে হিযরত করবেন, তারা ইনশাআল্লাহ অনেক আযর লাভ করবেন।
একবার রাসুলুল্লাহকে (সা.) এক ব্যক্তি বললো, আমাকে কিছু করতে বলুন। তখন রাসূল সা. বললেন, হিযরত করো, কারণ এর মতো আর কিছু নেই।
যেসব কারণে একজন মুসলিম হিযরত করতে বাধ্য হন:
১. আপনার দ্বীনের হেফাজতের জন্য। আল্লাহ বলেন,
يٰعِبَادِىَ الَّذِينَ ءَامَنُوٓا إِنَّ أَرْضِى وٰسِعَةٌ فَإِيّٰىَ فَاعْبُدُونِ
হে আমার বান্দারা যারা ঈমান এনেছো, নিশ্চয়ই আমার যমীন প্রশস্ত। সুতরাং, তোমরা আমারই ইবাদাত করো। [আল-আনকাবূত : ৫৬]
অর্থাৎ, আপনি এমন কোনো না কোনো জায়গা পেয়েই যাবেন যেখানে আপনি আল্লাহর ইবাদাত করতে পারবেন। আপনি বর্তমানে যেখানে অবস্থান করছেন সেখানে যদি আল্লাহর ইবাদাত করতে না পারেন, তবে বেরিয়ে পড়ুন। আপনি অবশ্যই এমন জায়গার খোঁজ পাবেন যেখানে আপনি নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদাত করতে পারবেন। মুজাহিদ (রহি.) বলেন, এই আয়াতের মানে হলো এই যে, ‘নিশ্চয়ই আমার যমীন প্রশস্ত। সুতরাং, হিযরত করো এবং জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্-এ অংশগ্রহণ করো।’ মুজাহিদের (রহি.) ব্যাখ্যা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সবসময়ই এমন কোনো না কোনো জায়গা থাকবে যেখানে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্ সংগঠিত হবে। কিন্তু জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাকে হিযরত করতে হতে পারে। সাঈদ ইবনে যুবাইর (রহি.) বলেন, এই আয়াতের মানে হলো - আপনি যে স্থানে অবস্থান করছেন সেখানকার লোকেরা যদি পাপী হয় এবং চারপাশে অনেক ‘মাআসি’ বা পাপকাজ সংগঠিত হয় তবে বেরিয়ে পড়ুন এবং আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য অন্য কোনো জায়গা খুঁজে নিন। সেই লোকটির মতো যে ৯৯টি খুন করে শেষমেশ ১০০তম খুনটি করেছিল, তখন আলিম তাকে কি বলেছিল? বেরিয়ে পড়ো এবং অন্যত্র হিযরত করো। মাতরাফ বিন আবদুল্লাহ (রহি.) বলেন, এই আয়াতের অর্থ হলো - ‘নিশ্চয়ই আমার যমীন প্রশস্ত। সুতরাং, তুমি অন্যত্র-ও তোমার রিযক লাভ করবে।’
২. আপনার নিরাপত্তার জন্য। এই ধরনের হিযরত মুসলিমরা করেছিলেন মক্কা থেকে আল-হাবশায় (আবিসিনিয়া)। তারা দারুল কুফর থেকে দারুল ঈমানে হিযরত করেননি, বরং তারা হিযরত করেছিলেন দারুল কুফর থেকে দারুল কুফরে৷ যেখানে তারা আল্লাহর ইবাদাত করতে পরছেন না এমন জায়গা হতে যেখানে তারা আল্লাহর ইবাদাত করতে পারবেন এমন জায়গায় হিযরত করেছিলেন। ফ্রান্স যখন আপনার মা-বোন-স্ত্রীদের হিজাবে উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, তাহলে অন্যত্র চলে যান যেখানে আপনি আল্লাহর ইবাদাত করতে পারবেন। আল্লাহর যমীন যখন এত বিশাল তখন পেছনে পড়ে থেকে আল্লাহ অবাধ্য হয়ে কি লাভ! আপনি কেন পেছনে পড়ে থাকবেন যখন সেখানে আল্লাহর আদেশ পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিছু বিষয় আছে যা মুস্তাহাব, এগুলো আপনি ছাড়তে পারবেন। কিন্তু এমন বিষয়গুলো আপনি ছেড়ে দিতে পারবেন না যা আপনার উপর ওয়াজিব। হিজাবের বিষয়টিও এমন। এটি বোনদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফারাইয। আপনি কেন এমন জায়গায় থাকতে যাবেন যেখানে আপনি এই ফরযগুলো মানতে পারবেন না? কিছু কিছু জায়গায় সালাতুল জুমুআ’র অনুমতি নেই। এমন জায়গায় আপনি কেন থাকতে যাবেন?
৩. জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্-র উদ্দেশ্যে হিযরত। জিহাদ এবং হিযরতের মধ্যকার এই সম্পর্ক অনেকগুলো আয়াত এবং হাদীসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ আযযা ওয়াযাল সূরাতুল আনফালের ২৪ নং আয়াতে বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ ءَامَنُوا وَهَاجَرُوا وَجٰهَدُوا بِأَمْوٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ ءَاوَوا وَّنَصَرُوٓا أُولٰٓئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ ۚ
নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে, হিযরত করেছে এবং নিজেদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে আর যারা তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সহায়তা করেছে, তারা একে অপরের বন্ধু...
আল্লাহ সূরাতুল বাক্বারাহর ২১৮ নং আয়াতে বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ ءَامَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجٰهَدُوا فِى سَبِيلِ اللَّهِ أُولٰٓئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَتَ اللَّهِ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও যারা হিযরত করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহর রহমতের আশা করে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
আবারও তিনটি বিষয়ের মধ্যকার সম্পর্ক - ঈমান, হিযরত এবং জিহাদ।
সূরা আন-নাহলের ১১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ هَاجَرُوا مِنۢ بَعْدِ مَا فُتِنُوا ثُمَّ جٰهَدُوا وَصَبَرُوٓا إِنَّ رَبَّكَ مِنۢ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
তোমার রব তাদের জন্য, যারা বিপর্যস্ত হওয়ার পর হিযরত করেছে, অতঃপর জিহাদ করেছে এবং সবর করেছে, এ সবের পর তোমার রব অবশ্যই ক্ষমাশীল, দয়ালু।
এই আয়াত হতে হিযরত এবং জিহাদের মধ্যকার সম্পর্ক প্রতীয়মান হয়।
সূরা আল-আনফাল আয়াত ৭৪,
وَالَّذِينَ ءَامَنُوا وَهَاجَرُوا وَجٰهَدُوا فِى سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ ءَاوَوا وَّنَصَرُوٓا أُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا ۚ لَّهُم مَّغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
আর যারা ঈমান এনেছে, হিযরত করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে এবং যারা তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সহায়তা করেছে, তারাই প্রকৃত মু’মিন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক রিযক।
আবারও তিনটি বিষয়ের মধ্যকার সম্পর্ক ফুটে উঠলো।
সূরাতিত তাওবাহ আয়াত ২০,
الَّذِينَ ءَامَنُوا وَهَاجَرُوا وَجٰهَدُوا فِى سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِندَ اللَّهِ ۚ وَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْفَآئِزُونَ
যারা ঈমান এনেছে, হিযরত করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে, আল্লাহ কাছে তারা অত্যন্ত মর্যাদাবান এবং তারাই সফলকাম।
অর্থাৎ, বারবার এই তিনটি বিষয়—ঈমান, হিযরত ও জিহাদ—এদের মধ্যকার সম্পর্ক প্রতীয়মান হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,
হিযরত ততদিন বহাল থাকবে যতদিন জিহাদ বহাল থাকবে।
রাসূল সা. আরও বলেন,
لا تنقطع الهجرة ما قوتل العدو
যতদিন শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ থাকবে ততদিন হিযরত থাকবে।
হিযরত কি দারুল কুফর থেকে দারুল ঈমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
এটি আমাদের সময়ের একটি যুগোপযোগী প্রশ্ন। আশ-শাওকানি (রহি.) বলেন, হিযরত শুধুমাত্র দারুল কুফর থেকে দারুল ঈমানের দিকেই সীমাবদ্ধ নয়। আপনি যদি এমন জায়গায় অবস্থান করেন যেখানে আপনি ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ বা সৎকাজের উপদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে পারছেন না, তাহলে আপনাকে ঐ স্থান ত্যাগ করে হিযরত করতে হবে। তিনি বলেন, একজন মু’মিনের উচিত এমন স্থানে হিযরত করা যেখানে সে সর্বোত্তম ভাবে আল্লাহর ইবাদাত করতে পারবে। আমরা যদি আশ-শাওকানির (রহি.) কথার সাথে আমাদের পরিস্থিতিকে মেলাতে চাই, যেহেতু আমাদের এই সময়ে মক্কা-মদিনার মতো সোজাসাপটা দারুল কুফর ও দারুল ঈমান নেই, তাই বলে কিন্তু হিযরতের বিষয়টিকে ছোট করে দেখা যাবে না। কারণ, হিযরত হতে পারে এক দেশ হতে অন্য দেশে বা একই দেশের এক শহর হতে অন্য শহরে, এমনকি একই শহরের এক মহল্লা হতে অন্য মহল্লাতেও হিযরত করা যেতে পারে। মুসলিম দেশগুলোতে একই শহরের কোনো মহল্লার বাসিন্দারা ধার্মিক হতে পারে এবং অন্য মহল্লায় থাকতে পারে ফিতনা-ফাসাদ। আপনি কি আপনার পরিবার নিয়ে ফিতনা-ফাসাদের মধ্য থাকতে চাইবেন? যখনই আপনার মনে হবে যে আপনি এবং আপনার পরিবার ফিতনায় পড়ে যাচ্ছেন এবং আপনাদের যেভাবে আল্লাহর ইবাদাত করার কথা ছিল সেভাবে পারছেন না তখনই আপনার উপর হিযরত প্রযোজ্য হবে।
আমরা যেহেতু হিযরত ফী সাবিলিল্লাহ্ নিয়ে আলোচনা করছি, এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। আমরা আগেই জেনেছি যে আজ আমাদের কাছে দারুল কুফর আছে কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট দারুল ঈমান নেই। দারুল কুফর এবং দারুল ঈমানকে পার্থক্য করা হয় শাসনব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে। কোনো স্থান যদি কুফফারদের শাসনব্যবস্থা অনুযায়ী পরিচালিত হয় তাহলে সেখানকার বাসিন্দারা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও স্থানটিকে দারুল কুফর বলে সংজ্ঞায়িত করা হবে। আবার কোনো স্থান যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয় তাহলে সেখানকার বাসিন্দারা কাফির হওয়া সত্ত্বেও স্থানটিকে দারুল ঈমান বলে সংজ্ঞায়িত করা হবে। এই দুয়ের পার্থক্যের ভিত্তি হলো বিধান বা হুকুম। এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে আল্লাহর ইবাদাত করা অন্যান্য জায়গার চাইতে সহজ, যদিও জায়গাটি দারুল কুফর হিসেবে সংজ্ঞায়িত। আরেকটি বিষয়, আপনি কেন এমন এক জায়গায় বাস করবেন যা এখনো দারুল কুফর এবং ভবিষ্যতেও দারুল কুফর থাকবে এমনকি ইসলামের শত্রু বনে যাবে? রাসূল সা. যেমনটা এক হাদীসে বলেছেন যখন অন্যান্য স্থানকে আপাতদৃষ্টিতে দারুল কুফর বলে মনে হয় কিন্তু প্রতিটি নিদর্শনের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে এটি ভবিষ্যতে দারুল ঈমান হবে এবং সেখানকার লোকেরা ইসলামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং আল্লাহ সেখানকার লোকেদের ইসলামের গ্রহণের জন্য এবং ইসলামের দাওয়াহ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করছেন। যেমন আশ-শাম যদিও এখন দারুল ঈমান নেই কিন্তু প্রতিটি নিদর্শনের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারছি যে আশ-শাম ইসলামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং এটি ভবিষ্যতে ইসলামের ভূমি হবে এবং এটি এমন এক জায়গা আমরা যার কাছাকাছি থাকতে চাই কারণ আমরা জানি এখানে ইসলামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে। একই কথা খাটে মক্কা, মদীনা, ইয়েমেন, খুরাসান, ইরাক প্রভৃতি স্থানের ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, আজ অবশ্য দরুল ঈমান নেই কিন্তু আমার সন্তানরা কোথায় কোন পরিবেশে বেড়ে উঠছে সেজন্য আমি দায়ী থাকবো। আমিই যদি তাদের দারুল কুফরে অবস্থানের কারণ হয়ে থাকি তবে আমি আমার নাতি-নাতনী এবং পরবর্তী সকলের জন্য দায়ী থাকবো। কারণ আমি তাদেরকে ভালো কোনো পরিবেশে লালনপালন করতে পারিনি। এমনকি আশ-শামের চেয়েও ভালো জায়গার কথা রাসূল সা. এক হাদীসে উল্লেখ করেছেন - আর-রিবাতের ভূমি এবং জিহাদের ভূমি। রাসূল সা. বলেন,
এক দিন এবং একরাতের রিবাত সারা মাস রোজা রাখার চেয়েও উত্তম।
তিনি আরও বলেন,
জিহাদের ময়দানে সা’আ পরিমাণ সময় অবস্থান করা হাজরে আসওয়াদের পাশে লাইলাতুর ক্বদরে ইবাদাতের চেয়ে উত্তম।
সা’আ হলো একঘণ্টার চেয়ে কিছুটা কম সময়। রাসূল সা. আরও বলেন,
রিবাত ফী সাবিলিল্লাহ্-র একদিন একহাজার রাতের চেয়ে উত্তম।
এক মহিলা রাসূল সা. এর কাছে এসে বললো, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার স্বামী আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বের হয়েছে। আমি সবসময় ইবাদাতে তার অনুকরণ করতাম। সে সালাত আদায় করতে আমিও করতাম, সে যিকর করলে আমিও তাই করতাম। আমাকে এমন কিছু করতে বলুন যা করলে সে এখন যে পরিমাণ সাওয়াব লাভ করছে আমিও তার সমান সাওয়াব পাবো”। রাসূল সা. বললেন, “তুমি কি সে আসা পর্যন্ত প্রতিরাতে সারারাত ইবাদাত করতে পারবে এবং সে আসা পর্যন্ত প্রতিদিন রোজা রাখতে পারবে এবং সে আসা পর্যন্ত লাগাতার যিকর করতে পারবে?” মহিলাটি বললো, “না, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি পারবো না”। রাসূল সা. তখন বললেন, “তুমি যদি এগুলো সব করতে সক্ষমও হও তবুও তোমার স্বামী এখন যে পরিমাণ সাওয়াব অর্জন করছে তার এক-দশমাংশও হবে না। তাই চেষ্টাও কোরো না”। এই মহিলা কোথায় অবস্থান করছিলেন? মদীনায়। যেখানে সালাতের সাওয়াবকে এক হাজার গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
সুতরাং, হিযরত ফী সাবিলিল্লাহ্ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। একজন মুসলিম কখনো এমন অবস্থায় থাকতে চায় না যেখানে সে কুফফারদের ট্যাক্স দিচ্ছে এবং তা দিয়ে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে। সে এমন অবস্থায় থাকতে চায় না যেখানে সে কুফফারদের সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। সে এমন অবস্থায় থাকতে চায় না যেখানে কুফফাররা তাকে দিয়ে তার নিজের লোকেদের বিরুদ্ধেই ফাতওয়া জারি করিয়ে নিচ্ছে বা উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। একজন মুসলিম কখনো এমন অবস্থায় থাকতে চায় না যেখানে সে তার সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে এমন অবস্থায় থাকতে চায় না যেখানে সে নিজে হয়তো আল্লাহর ইবাদাত করতে পারছে কিন্তু তার স্ত্রী-সন্তানের জন্য ইসলামের উপর দৃঢ় থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মুসলিমদের এমন স্থানের খোঁজ করা উচিত যেখানে তারা সর্বোত্তমভাবে আল্লাহর ইবাদাত করতে পারবে। আমরা আমাদের রিযকের জন্য সর্বোত্তম স্থানের খোঁজ করবো না বরং আমাদের ইবাদাতের জন্য সর্বোত্তম স্থানের খোঁজ করবো। রিযকের বিষয়টা আল্লাহর হাতে। হিযরত ফী সাবিলিল্লাহ্-র ক্ষেত্রে এটাই আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
হিযরতের বিষয়ে আলোচনা করার সময় আরও একটি বিষয় উত্থাপন না করলেই নয়। এবং বিষয়টি হলো এখনকার সময়ে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্-র হুকুম। জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্ এখন অত্যাবশ্যকীয়, ফারযুল আঈন। কারণ, এখনকার জিহাদ হলো আত্মরক্ষামূলক। দারুল কুফরে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য হিযরত যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি আরও একটি বাধ্যতামূলক কাজ হলো জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্। দরুল কুফরে বসবাসকারী মুসলিমের কাছে দুটি রাস্তা খোলা আছে—হয় দারুল কুফরে থেকে গিয়ে ধর্মীয় সকল বাধ্যবাধকতা পূরণ করা, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্-ও যার অন্তর্ভুক্ত; অথবা বেরিয়ে পড়া। আপনি যদি থেকে যান এবং এই বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণে ব্যর্থ হন তার মানে হলো আপনি আল্লাহর ইবাদাত করতে পারছেন না। আর যদি আপনি আল্লাহর ইবাদাত করতে না পারেন তবে বেরিয়ে পড়ুন। উক্ত বিষয়টি হিযরতের অংশ না হলেও হিযরতের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কারণ জিহাদ আজ সকল মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। পশ্চিমে বসবাসকারী মুসলিমদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি যদি থেকেও যান তবুও আপনাকে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্-এ অংশ নিতে হবে। হয় নাফসের মাধ্যমে, নয়তো মালের মাধ্যমে। জিহাদ শুধুমাত্র সম্মুখসমরে যুদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অর্থনৈতিক জিহাদও রয়েছে। গনিমতের উদ্দেশ্যে জিহাদ। বদরের আগ পর্যন্ত রাসূল সা. যেসকল গাযওয়া এবং সারিয়া প্রেরণ করেছিলেন সবগুলোর উদ্দেশ্য ছিল গনিমত অর্জন। কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা হামলার মাধ্যমেই তারা গনিমত অর্জন করতেন। এটি জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্-র একটি ধরণ যাতে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্-র সমানই আযর রয়েছে। অর্থাৎ, কুফফারদের মাঝে থেকেও জিহাদের বাধ্যবাধকতা পূরণের এটি একটি উপায়। কিন্তু কারও যদি জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকে তবে তার উচিত বেরিয়ে পড়া। কারণ সে আল্লাহর ইবাদাত করতে পারছে না। আর আল্লাহ আযযা ওয়াযাল বলেন,
——————————يٰعِبَادِىَ الَّذِينَ ءَامَنُوٓا إِنَّ أَرْضِى وٰسِعَةٌ فَإِيّٰىَ فَاعْبُدُونِ
হে আমার বান্দারা যারা ঈমান এনেছো, নিশ্চয়ই আমার যমীন প্রশস্ত। সুতরাং, তোমরা আমারই ইবাদাত করো। [আল-আনকাবূত : ৫৬]
টীকা:
[১] সহিহুল বুখারী : ১০ ও ৬৪৮৪; সহিহ মুসলিম ১/১৪ হাদীস নং ৪০; মুসনাদু আহমাদ : ৬৭৬৫। হাদীসের মান : সহিহ।
[২] যিনি হিযরত করেন।
[৩] মুসনাদু আহমাদ : ১৭৮০০; জামে আত-তিরমিযী : ২৮৬৩।
[৪] সুনানু আবু দাউদ : ২৬৪৫; জামে আত-তিরমিযী : ১৬০৪। আল-আলবানি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[৫] সুনানুন নাসায়ি : ৩১৩৪; সহিহ ইবনু হিব্বান : ৪৫৯৩; মুসনাদু আহমাদ : ১৫৯৫৮।

0 Comments