শাইখ আহমাদ ইয়াসিন : জীবন ও কর্ম


 


আজ আমরা যাকে নিয়ে কথা বলব তিনি খুব বিখ্যাত এবং অসাধারণ একজন মানুষ। সত্যিকার অর্থে তাকে সংজ্ঞায়িত করতে চাইলে বলতে হয়—তিনি ছিলেন খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং দৃঢ় মানসিকতার মানুষ। আমরা যদি বড় ইমাম শাইখুল ইসলাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের কথা বলি তাহলে বলা যায়—তিনি একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন। যদি আমরা ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ সম্পর্কে বলি তাহলে বলা যায়—তিনি ছিলেন জ্ঞানের সাগর। ইবনুল কাইয়্যিম সম্পর্কে বলা যায়—তিনি ছিলেন উৎসাহী ব্যক্তি। ইবনুল জাওযী ছিলেন প্রকৃষ্ট দাঈ। আয-যাহাবী তার নিরপেক্ষতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।  ইযযুদ্দিন আব্দুস সালাম ছিলেন ন্যায়ের প্রচার এবং অন্যায়ের দমনের জন্য বিখ্যাত। 


আমাদের প্রত্যেক আলিমের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল যার মাধ্যমে আমরা তাদেরকে অন্য সবার থেকে আলাদা করতে পারি। ঠিক সেভাবেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দৃঢ় মানসিকতার ব্যক্তি হিসেবে আমরা শাইখ আহমাদ ইসমাঈল হাসান ইয়াসিনকে আলাদা করতে পারি। তিনি আসলেই একজন মহান মুসলিম ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা, চিন্তা ও মানসিকতা ছিলো ইস্পাত কঠিন। তাকে কোনোভাবেই কেনা সম্ভব ছিল না। 


তিনি এমন এক সময় উম্মাহর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যখন উম্মাহ এক ভয়াবহ ক্রান্তিকালের সম্মুখীন। তিনি একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করেছেন এবং তাদেরকে মুক্তির সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। উম্মাহর সুদিনেও তিনি উম্মাহর জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন কিন্তু মানসিকভাবে ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী। 


গাজা উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশে ক্বাদা আল মাজলার যাওরাত আসকালানের এক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৩৫৫ হিজরীতে (১৯৩৬ সালে) জন্মগ্রহণ করেন। সঠিক তারিখটি আমি বলতে পারছিনা। উম্মাহ হিসেবে আমরা হিজরী ক্যালেন্ডার খুব একটা অনুসরণ করি না। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই লজ্জার। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে আমরা অধিক মনোযোগ দিয়ে থাকি। 


ব্যাপক প্রতিরোধের সময় শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের জন্ম হয়। তখন শাইখ ইযয উদ্দিন আল-কাসসামের শাহাদাতের দরুন পুরো ফিলিস্তিন উত্তপ্ত ছিল। তিনি ছিলেন সিরিয়ান বংশোদ্ভূত ফিলিস্তিনি। আল্লাহ উনার শাহাদাত কবুল করুন। শাইখ আল-কাসসামের মৃত্যুর পর প্রায় ছয় মাস ধরে প্রতিরোধ চলতে থাকে। একে ‘মহান প্রতিরোধ’ বা ‘বিখ্যাত প্রতিরোধ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। দুঃখজনকভাবে আরব দেশগুলোর সহায়তায় এ প্রতিরোধও দমন করা হয়। যদি এ প্রতিরোধ চলতে থাকতো তাহলে আজ হয়তো ইতিহাস আমরা অন্যভাবে পড়তাম। 


এমন বিখ্যাত সময়ে সে বিখ্যাত মানুষটির জন্ম হয়। আল্লাহ তাঁর জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত প্রতিটি সময়ে তাঁকে রক্ষা করেছেন। শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের পুরো জীবন বিস্ময়কর সব ঘটনা দিয়ে পরিপূর্ণ। এসব ঘটনা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহ তাকে কীভাবে সাহায্য করেছেন। তাকে নিয়ে আল্লাহর একটি বড় পরিকল্পনা ছিল এবং তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ তা বাস্তবায়ন করেছেন। এটা আল্লাহর সেই আয়াতের প্রতিফলন যেখানে তিনি বলেছেন, 

وَ الَّذِیۡنَ جَاہَدُوۡا فِیۡنَا لَنَہۡدِیَنَّہُمۡ سُبُلَنَا

যারা আমার রাস্তায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায় আমি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করি। [আল-‘আনকাবূত : ৬৯]


আপনি যদি চান আল্লাহ আপনাকে পরিচালিত করুক তাহলে আপনি তাঁর রাস্তায় সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করে যান। এমনসব পথে আপনি সাহায্য লাভ করবেন যা আপনি কখনও কল্পনাও করেননি। এটা আল্লাহর একটি সুন্নাহ। এ সুন্নাহ আমরা বাস্তবায়িত হতে দেখি ইমাম, মুজাহিদ, হাফিজ ও আলিমদের জীবনে। অতীত থেকে বর্তমান—আল্লাহর সুন্নাহ কখনো পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ পরিশ্রমের মূল্য অবশ্যই দেন—সেটা যেভাবেই হোক না কেন।


আল্লাহ শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে তাঁঁর জন্মেই সাহায্য করেছেন। আহমাদ ইয়াসিনের মায়ের ননদ ছিল এবং তার বাবার অন্য স্ত্রীও ছিল। সেসব মহিলারা তাকে প্রচন্ড হিংসা করত। একদিন তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে তাঁর কাছে এক লোক এসে বলছে শীঘ্রই তাঁর একটি ছেলে হবে। তিনি যেন তাঁর নাম ‘আহমাদ’ রাখেন। তাঁর গর্ভধারণের প্রথম দিকে তিনি এ স্বপ্নটি দেখেন। হিংসা এবং কুনজরের ভয়ে তিনি এ কথাটি সবার থেকে গোপন রাখেন। 


আহমাদ ইয়াসিন অন্য পাঁচ-দশজন ফিলিস্তিনি যুবকের মতই বড় হতে থাকেন। তিনি ব্রিটিশদের নির্মম পাশবিক শাসন দেখেছিলেন। পরবর্তীতে এরাই ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনের মানুষের জমি দিয়ে দেয়। তারা সেখানে গেড়ে বসে। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। 

চার কি পাঁচ বছর বয়সে তিনি একটি ব্রিটিশ ক্যাম্পে ঢুকে পড়েন। সৈন্যরা তাঁকে গোসল করাতে নিয়ে যেত। একদিন তিনি সৈন্যদের আগেই নদীতে চলে যান। তিনি সাঁতার জানতেন না। তাও পানিতে নেমেছিলেন। যা হওয়ার তাই হলো। তিনি ডুবে যেতে লাগলেন। একজন ব্রিটিশ অফিসার দ্রুত ঝাঁপ দিয়ে তাকে তীরে নিয়ে আসেন। এভাবে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেন। 


আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। বিষয়টি আমাকে সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুবের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাঁর বাবা আইয়ুব ইবনে সাদী ইরাক থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর তিনি লেভান্তে (levant) যাওয়ার চিন্তা করেন। কারণ সেখানে কিছু দুর্ভাগ্যজনক, নির্মম পরিস্থিতি চলছিল। আসাদ উদ্দিন শিরকুহ নামের অসাধারণ এক লোক তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন সালাহউদ্দিনের চাচা। তারা তাদের পরিবার ও সম্পদ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে সালাহউদ্দিন কোনো কারণ ছাড়াই কাঁদতে থাকেন। তিনি কারও কথা শুনছিলেন না। এতে আইয়ুব বিন সাদী এত রেগে যান যে তিনি হয়তো তাঁর ছেলেকে মেরেই ফেলতেন। কিন্তু তাঁর পরিবার তাঁকে এ কাজ করতে বাধা দেয়। 


সুবহানাল্লাহ! এ ছিঁচকাঁদুনে ছেলেই পরবর্তীতে ইসলামকে একটি ব্যাপক বিজয় এনে দেয়। আর সেদিন ডুবে যাওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া সে আহমাদ ইয়াসিন বিশ্বজোড়া মুজাহিদদের নেতা হিসেবে পরিগণিত হন এবং আজকে আমরা তাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আহমাদ ইয়াসিন যখন ছোট ছিলেন তখন মুসলিম বিশ্বের অবস্থা কেমন ছিল সেটা আমাদের বাবা-মায়েরা ভালো বলতে পারবেন। তাদের দ্বীনের বুঝ ছিল কম, তাদের সংস্কৃতি ইসলামের সাথে খুব কমই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল এবং ইসলামের জন্য তাদের অবদান ছিল খুব সামান্য। তারা এভাবেই আমাদেরকে গড়ে তুলেছেন এবং আজ আমাদের এ অবস্থা। তখন কাফির সাম্রাজ্যবাদীরা সমগ্র বিশ্বে মুসলিমদের ভূমিগুলো দখল করে চলছিল এবং আমাদেরকে তাদের মতো জীবন যাপন করতে বাধ্য করছিলো। আরবের খুব অল্প কিছু জায়গা তাদের হাতের বাইরে ছিল।


সাম্রাজ্যবাদীদের শাসনের সময় থেকে মুসলিমদের ঈমান এবং ইসলামে বিকৃতি শুরু হয়। ফলে তারা ধীরে ধীরে ইসলামের গণ্ডির বাইরে বের হতে থাকে। এমন একটা সময়ে শাইখ আহমাদ ইয়াসিন বড় হতে থাকেন। আল্লাহ তাকে এমন এক পরিস্থিতিতে বড় করেছেন যেন তিনি ঐ পরিস্থিতিতে এমন কিছু জিনিস শিখতে পারেন এবং শিখে এমন কিছু করতে পারেন যা কিনা কোনো মুসলিম রাষ্ট্র করতে পারেনি। তিনি যেখানে জন্মগ্রহণ করেন সেখানে তিনি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তারপর ১৩৬৭ হিজরীতে (১৯৪৮ সালে) যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে ফিলিস্তিনের ৮০ শতাংশ ভূমি দখল হয়ে যায়, হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়, অসংখ্য মুসলিম নিহত হয় এবং পুরো মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে এটি একটি কালো দাগ কেটে যায়। 


তখন শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের বয়স ছিল ১২ বছর। এ ঘটনা তাঁকে মারাত্মকভাবে শিহরিত করে। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে আহমাদ ইয়াসিন ও তার পরিবার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গাজায় পৌঁছান। অনেক দুঃখ, অনিশ্চয়তা এবং দারিদ্র্য নিয়ে তারা গাজায় বসবাস শুরু করেন। তখন বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিদের অবস্থা এমনই ছিল। তাদের না কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল, না কোথাও থাকার জায়গা ছিল। এধরনের অবস্থা মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে খুব কমই এসেছে।

সাত সদস্যের এক দরিদ্র কবলিত পরিবারে শাইখ আহমাদ ইয়াসিন কি করতে পারতেন? অল্প বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। পৃথিবীর বুকে তিনি এতিম হয়ে পড়েন। আল্লাহ তাকে প্রতিবার সমস্যা থেকে রক্ষা করেছেন। তাঁর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য আহমাদ ইয়াসিন গাজায় একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি নেন। তাঁর পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল যে তিনি পড়ালেখা শেষ করবেন। তাই যখনই তিনি সুযোগ পেলেন তখনই স্কুলে ফিরে যান এবং সেকেন্ডারী স্কুলের পড়ালেখা শেষ করেন। 


তাঁর স্কুলের প্রথম বছরেই একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। তিনি তাঁর বন্ধুদের সাথে সমুদ্রতীরে খেলতে গিয়েছিলেন। ফুটবল খেলার সময় হঠাৎ তিনি পড়ে যান এবং ঘাড়ে আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ৪৫ দিন তাঁকল প্লাস্টার করে রাখা হয়। যখন তার প্লাস্টার খোলা হয়, সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা যতটুকু ছিল তাতেই বলা গিয়েছিল যে তাঁর শরীরের কিছু অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তিনি আর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না, সারা জীবন তাঁকে এভাবেই থাকতে হবে। বন্ধুদের সহায়তায় তিনি হাঁটতে পারতেন কিন্তু রাস্তার একটি ছোট পাথর কিংবা হালকা একটু ঠেলায়ও তিনি পড়ে যেতেন। হুইল চেয়ার ব্যবহার শুরু করার আগ পর্যন্ত তাঁর এ অবস্থাই ছিল। ঘটনাটি ছিল ১৪০৫ হিজরীর। তার জীবনের শেষ ২০ বছর তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আগ পর্যন্ত তিনি এভাবে চলেছেন। 

পড়ালেখা শেষ করার পর তিনি শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য, বিষয়টা তার জন্য সহজ ছিল না। সেটা তার শারীরিক সমস্যার কারণেই বলুন বা দারিদ্র্যের কারণেই বলুন। তিনি শেষমেশ পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং হাজারো পরীক্ষার্থীর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছিলেন। যিনি পরীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি আহমাদ ইয়াসিনকে বললেন যে শারীরিক অক্ষমতার জন্য তিনি পড়াতে পারবেন না। শাইখ ইয়াসিন অনেক অনুরোধ করলেন কিন্তু সে লোকটি তাঁর কথা শুনলেন না। তাঁকে প্রশাসনিক কাজের জন্য চেষ্টা করতে পরামর্শ দিলেন তিনি। আহমাদ ইয়াসিনকে এজন্য তিনি আরেকটি পরীক্ষার কথা বললেন। কিন্তু তাঁকে সে পরীক্ষাটিও দিতে দেওয়া হলো না। তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন এবং হতাশ হয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। পরবর্তীতে আল্লাহর ইচ্ছায় সে লোকটি আহমাদ ইয়াসীনের সাথে দেখা করে বলেন যে তারা তাঁকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে প্রস্তুত। শাইখ ইয়াসিন যখন তাকে ধন্যবাদ দিলেন তখন সে লোকটি বলল এ কাজটি করেছেন আসলে আরেকজন। ঐ লোক বাদপড়া মানুষদের তালিকা দেখছিল এবং একপর্যায়ে শাইখ আহমাদ ইয়াসিন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। দেখুন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে কীভাবে সাহায্য করেছেন! ঐ লোককে বলা হলো যে শারীরিক অক্ষমতার কারণে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু লোকটি দেখে অবাক হয়ে গেল যে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের সকল পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর বেশি ছিল, এমনকি তিনি অন্যতম সেরা রেজাল্ট নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাই লোকটি শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে একটি পদের প্রস্তাব দিল এবং তাকে ঐ পদে নিয়োগ দিল। 


শাইখ আহমাদ ইয়াসিন গাজায় একজন শিক্ষক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। চিকিৎসার জন্য তিনি নিয়মিত মিশরে যেতেন। তখন সময় ১৩৭০ হিজরি। মিশরেই তিনি ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’-এর সাথে পরিচিত হন। তাদের মূলনীতি এবং কার্যক্রমে তিনি অভিভূত হন এবং সদস্যপদ গ্রহণ করেন। যদিও তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেননি, কিন্তু তিনি তাদের মূলনীতিকে পছন্দ করতেন। তাদের মূলনীতি ছিল সর্বাঙ্গীণ। তিনি তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনকে ইজরাইলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি ভেবেছিলেন যে ফিলিস্তিনের এই ইস্যুতে ইখওয়ানের সমর্থন ও তাদের মূলনীতি তার এই আকাঙ্খা পূরণের জন্য যথেষ্ট হবে। তিনি সংগঠনটিকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন। ইখওয়ানের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করেই তিনি নিয়মিত মিশরে যাওয়া আসা করতেন। ইখওয়ানের সদস্যরা তখন কুখ্যাত স্বেচ্ছাচারী আব্দুন নাসেরের হাতে অত্যাচারীত হচ্ছিলেন। 


১৩৮৪ হিজরিতে (১৯৬৪ সালে) তিনি মিশরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির একজন পার্টটাইম শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হতে চাইলেন। আল্লাহ তাঁকে সফলতা দান করলেন, তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহীত হলেন এবং প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেন। 


১৩৮৫ হিজরিতে (১৯৬৫ সালে) মস্কোতে অবস্থানকালীন আব্দুন নাসের ঘোষণা দিল যে ১৩৭৪ হিজরিতে (১৯৫৪ সালে) ইখওয়ানুল মুসলিমিনের যেসকল সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের যেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবার আটক করা হয়। সহস্রাধিক সদস্যকে আটক করা হয়, শাইখ আহমাদ ইয়াসিনও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি মিশরের অধিবাসী নন, তাই তাকে স্থানান্তরিত করা হলো। ফলে মিশরে তিনি তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি, যেহেতু আরোপিত শর্তাবলি ছিল কঠোর। তিনি গাজায় চলে গেলেন। যেহেতু তিনি ইখওয়ানের মূলনীতিগুলোকে খুব পছন্দ করতেন, তাই সেখানে তিনি লোকেদের আহ্বান করতে শুরু করলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ বক্তা, এমনকি সেসময়ে গাজার শ্রেষ্ঠ বক্তা। সুবহানাল্লাহ! তার অক্ষমতা সত্ত্বেও তিনি একজন সুদক্ষ এবং সুপরিচিত বক্তা হয়ে উঠেছিলেন। তার প্রভাববিস্তারকারী এবং শক্তিশালী বক্তৃতার কারণে তৎকালীন গাজা উপত্যকার ক্ষমতায় থাকা মিশরীয় গোয়েন্দা বাহিনী তাকে আটক করে। ১৩৬৭ হিজরিতে (১৯৪৮ সালে) প্রথম যুদ্ধের পর গাজার শাসন ক্ষমতা মিশরের হাতে চলে যায়। আহমাদ ইয়াসিনকে এক মাসের মতো আটক করে রাখা হয়। কিন্তু ইখওয়ানের সাথে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি। তিনি বলেছিলেন যে তিনি ইখওয়ানকে সম্মান করতেন, তাই তারা এক মাস পর তাকে ছেড়ে দিল। পরিস্থিতি খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কঠোর পরিশ্রম করে যেতে লাগলেন। এমনকি কেবল মিশর ও ফিলিস্তিনেই নয়, বরং বেশিরভাগ আরব এবং মুসলিম রাষ্ট্র তখন অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি ছিল। খুব কম সংখ্যক যুবকই সালাত আদায় করতো। পুরো ইসলামি বিশ্বেই এমন অবস্থা বিরাজ করছিল। খুব কম লোকই রোজা রাখতো, দ্বীন সম্পর্কে জানতো, হাজ্জে যেতো। কিন্তু এগুলোই তো ইবাদাতের ভিত্তি। আমরা যদি তখনকার ইসলামি সংস্কৃতি, ইসলামি পুনর্জাগরণ বা দ্বীনি ইলমের দিকে তাকাই—তখনকার যুবসমাজ ছিল একেবারেই উদাসীন। তারা হারিয়ে গিয়েছিল। আহমাদ ইয়াসিন তার জীবনীগ্রন্থে এ ব্যপারে লিখেছেন। আমি আপনাদেরকে গ্রন্থটি পড়ার অনুরোধ করবো। গ্রন্থটির নাম ‘যুগের সাক্ষী’ (A Witness to an Era); যেটিকে আহমাদ মনসুর আল-জাযিরা চ্যানেলে উপস্থাপন করেছিলেন। আহমাদ ইয়াসিন বলেন,

ধর্মীয় কার্যক্রম ছিল উপেক্ষণীয়, কোনো ধর্মীয় পুনর্জাগরণের উপস্থিতি ছিল না।


এবং সেক্যুলার এবং বামপন্থী সংগঠনগুলো তখন ফিলিস্তিনে প্রভাব বিস্তার করছিল, যেমনটা আমরা সকলেই জানি। সেখানে বলতে গেলে কোনো ইসলামি আহ্বান ছিল না, কিছু দমিত আহ্বান যা ছিল তার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল না। এই বিষয়টি খুবই পরিচিত, এমনকি শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহি.) তাঁর জীবনীগ্রন্থ রচনার সময় এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। 


আহমাদ ইয়াসিন ধীরেধীরে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন এবং ১৩৮৮ হিজরিতে (১৯৬৮ সালে) ফিলিস্তিনে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতৃত্ব লাভ করলেন। শারীরিক দূর্বলতা এবং অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন এক মহৎ ব্যক্তি। তিনি তার সংকল্পে ছিলেন অটল এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো তিনি দ্বীনের জন্য কাজ শুরু করলেন, তিনি তাঁর সমস্ত শ্রম ব্যয় করলেন বীজ বপন, তাতে পানি দেয়া এবং তার পরিচর্যায়। তাঁর চোখের সামনে তারা বড় হতে লাগলো, পুষ্ট এবং পরিপক্ব হতে লাগলো। তাঁকে ঘিরে যেসকল লোক ছিল তাদের সংখ্যা ছিল বৃহৎ। এত বৃহৎ যে তাদের হারানো বা দমন করা বা উপড়ে ফেলা ছিল অসম্ভব। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। আল্লাহর ইচ্ছায় আহমাদ ইয়াসিন শাহাদাত বরণ করলেন। 


আনেকেই আছেন যারা তাদের কাজের ফল দেখার আগেই মারা যান। তারা কঠোর পরিশ্রম করেন, সমস্ত শ্রম ও সময় ব্যয় করেন এবং ফল প্রত্যক্ষ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু আহমাদ ইয়াসিনকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন। তিনি ফিলিস্তিনে জিহাদের প্রথম বীজটি বপন করেছিলেন, একে শক্তিশালী করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন যতক্ষণ না তা একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পরিপক্ব হয়। আর তা-ই হয়ে উঠেছিল ফিলিস্তিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহে। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন যখন তার মিশন পরিপূর্ণ করলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা চাইলেন তিনি যেন শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এরূপ সাহসিকতাপূর্ণ জীবনাবসান আল্লাহর অনুগ্রহের আরেকটি নিদর্শন। 


শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে প্রায়শই দুঃখের সাথে স্বরণ করা হয়, তার কারণ হলো ১৩৮৭ হিজরির (১৯৬৭ সালের) ছয় দিনের যুদ্ধে ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় ঘটনা। সেসময় আরবের সকল দেশ আব্দুন নাসেরের অনুসরণ করছিল। তারা এমন এক কাল্পনিক বিজয়ের সন্ধানে ছিল যা ইসলামের সাথে অসম্পর্কিত, ইসলামি শিক্ষা থেকে বিচ্যুত এবং সত্য ইসলামি জীবন থেকে বহুদূরে। তখন পুরো আরব বিশ্বে সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম এবং বামপন্থী ভাবধারার দর্শন এবং আদর্শ বিস্তার লাভ করেছিল, এবং তবুও তারা বিজয়ের আশা করছিল! এমনটা কখনোই সম্ভব নয়, কারণ এটি আল্লাহর রাস্তা নয়। গাজায় আব্দুন নাসেরের শাসনামলে দ্বীনের ক্ষেত্রে তারা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন তা আহমাদ ইয়াসিনকে হতবাক করে দিয়েছিল। তিনি বলেন, 

যদি কোনো বক্তা মাসজিদে খুতবায় আব্দুন নাসেরের বিরুদ্ধে কিছু বলতো, তবে তাকে তার বক্তৃতা চলাকালীন সময়েই শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো।

তিনি বেদনাদায়ক আরও কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন যাতে স্পষ্টভাবে সেসময়কার আরবদের মধ্যে যেকোনো প্রকার চেতনার অভাব প্রতীয়মান হয়। সকল আবর রাষ্ট্রই ভ্রান্ত নীতির অনুসরণ করছিল। এমন কঠিন মুহূর্তেই আহমাদ ইয়াসিন লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।


আজ আমরা দ্বীনি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছি, মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছি, দ্বীনি দারসে উপস্থিত থাকছি, আজ আমাদের মাসজিদগুলোয় সাধারণ মানুষ, বক্তা, শাইখ এবং আলিমের সমাগম, কিন্তু আমাদের কেউই সবচেয়ে জরুরি দ্বীনি কর্মকাণ্ডগুলোয় অংশগ্রহণ করছি না এবং গুরুত্বের সাথে দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছি না। এই বিলাসী জীবন আমাদের রুহের মৃত্যু ঘটাচ্ছে, দুনিয়াবি জীবনের প্রতি আমাদের আশা, আকাঙ্খা, আসক্তি দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সকল কিছুই ইঙ্গিত করছে যে ইসলামের হারানো গৌরব আবার ফিরে আসবে। আমাদের জীবনের সবকিছুই চায় ইসলামের বিজয়। তবুও আমরা গুরুত্বের সাথে কোনো কাজ করছি না। আমাদের পূর্ববর্তীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। তখন কোনো লক্ষণই ইসলামের বিজয়ের ইঙ্গিত করছিল না। সকল ক্ষেত্রে— হোক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক বা প্রযুক্তিগত—তখন ছিল এক অন্ধকার যুগ। তা সত্ত্বেও তারা লড়াই চালিয়ে গিয়েছে এবং দিন-রাত তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, এটাই ছিল তাদের মাহাত্ম্যের চাবিকাঠি। 


যেমনটা বলেছি, আহমাদ ইয়াসিন ছিলেন এক ইস্পাত-দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির ব্যক্তি, যিনি জানতেন না হতাশা বা পরাজয় কি জিনিস। একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তার অক্ষমতা, পক্ষাঘাত এবং অন্যান্য যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি তিনি হয়েছিলেন তার জন্য তিনি কখনো আশাহত হয়েছিলেন কিনা। তিনি এই প্রশ্নের এক চমৎকার উত্তর দিয়েছেন। উত্তরে তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন, 


وَ ظَنُّوۡۤا  اَنَّہُمۡ  مَّانِعَتُہُمۡ حُصُوۡنُہُمۡ مِّنَ اللّٰہِ  فَاَتٰىہُمُ اللّٰہُ مِنۡ حَیۡثُ لَمۡ یَحۡتَسِبُوۡا ٭  وَ قَذَفَ فِیۡ  قُلُوۡبِہِمُ  الرُّعۡبَ

তারা ধারণা করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহর আযাব এমন এক দিক থেকে আসল যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি এবং তিনি তাদের অন্তরসমূহে ত্রাসের সঞ্চার করলেন। [আল-হাশর : ০২]

তিনি আশা করেছিলেন যে তারা একদিন ফিলিস্তিন থেকে ইয়াহুদীদের বের করে দিতে সক্ষম হবেন, তাদের মনে ভীতি সঞ্চার করবেন এবং এর ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়বে। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় এবং তাওফিকে এমনটাই হয়েছিল। তিনি তিলাওয়াত করেছিলেন,


مَا ظَنَنۡتُمۡ اَنۡ  یَّخۡرُجُوۡا وَ ظَنُّوۡۤا  اَنَّہُمۡ  مَّانِعَتُہُمۡ حُصُوۡنُہُمۡ مِّنَ اللّٰہِ

তোমরা ধারণাও করনি যে, তারা বেরিয়ে যাবে। আর তারা ধারণা করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করবে। [আল-হাশর : ০২]

তিনি বলেছেন যে তাঁরা যা আকাঙ্খা করেছিলেন তার চেয়ে বেশি লাভ করেছেন এবং সকল প্রসংশা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার। তাদের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং আনুগত্যের ফল তিনি দিয়েছেন। 


মানুষের কেবল নিজের জন্য নয়, নিজের আশা এবং আকাঙ্খার জন্য নয়, এমনকি নিজের লোভের জন্য নয়, বরং মানুষের বাঁচা উচিত অন্যের জন্য। মানুষের নিজের পুরো জীবনকে নগন্য এবং গুরুত্বহীন লক্ষ্যের পেছনে ব্যয় করা উচিত নয়, বরং তাদের উচিত অন্যের কথাও ভাবা এবং তাদের সাহায্যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া যাতে করে তার জীবনকালে কিছু অবদান রেখে যেতে পারে। যখন কেউ মারা যায়, আমরা তার কাজগুলো স্বরণ করি। আমরা জিজ্ঞেস করিনা কেউ বেঁচে আছে না মারা গেছে, যেহেতু এই জীবনের কোনো মূল্যই নেই। মানুষের উপর ঐ ব্যক্তির জীবনের প্রভাব যেমন, তার মৃত্যুর প্রভাবও তেমনই। কিন্তু শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের জীবন এমন ছিল না। মূলত তিনি একজন মহান এবং বিজড়িত ব্যক্তি ছিলেন, যিনি আমৃত্যু লড়ে গিয়েছেন। 


১৩৯০ হিজরি (১৯৭০ সাল), ক্রমশ দ্বীনি জাগরণ ঘটতে শুরু করল। কিন্তু এর শুরুটা ছিল ধীর। এই জাগরণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো ১৩৯৩ হিজরির দশম রামাদানের যুদ্ধে, ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে। দীর্ঘ সময়ের হতাশা এবং ক্রমাগত পরাজয়ের পর মানুষ বুঝতে শুরু করলো যে এই ধূর্ত এবং শক্তিশালী শত্রুকেও হারানো এবং বিজয় অর্জন করা অসম্ভব নয়। কিন্তু আহমাদ ইয়াসিন লোকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি খুব অসাধারণ কিছু কথা বলেছিলেন এবং ভবিষ্যতের এক স্পষ্ট ভিশন ছিল তার। তার এই তীক্ষ্ণ দুরদর্শিতা ছিল আল্লাহর এক রাহমাহ। তিনি বলেছিলেন যে এই যুদ্ধ ইয়াহুদীদের সাথে শান্তির প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে না। তিনি অনুভব করেছিলেন যে এই যুদ্ধের লক্ষ্য আরব দেশগুলোকে স্বাধীন করা নয় এবং এর মূল্য হতে পারে ইয়াহুদীদের সাথে শান্তিচুক্তি; এবং এমনটাই ঘটেছিল। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন অন্যান্য পরিস্থিতিতেও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। ৬ অক্টোবরের যুদ্ধে এমনটাই ঘটেছিল, কিন্তু তা মানুষকে আশার আলো দেখিয়েছিল এবং অনেকের সম্বিৎ ফিরিয়ে দিয়েছিল। আমি আপনাদের আগেই রামাদানের যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছিলাম। এক মিশরীয় অফিসার আমাকে বলেছিলেন যে তারা মিশরীয় সৈন্যদের জলদি কবর দিয়ে দিতেন এবং ইয়াহুদীদের ক্ষেত্রেও একই কাজ করতেন৷ তারা মিশরীয়দের কবরগুলো চিহ্নিত করে রাখতেন। তিনি বলেন, অক্টোবর যুদ্ধের কয়েকমাস পরে, ১৩৯৪ হিজরির প্রথম তৃতীয়াংশে কবরগুলো খোলা হলো যাতে করে মৃতদেরকে তাদের পরিবারের লোকেরা নিয়ে যেতে পারে। উত্তর মিশর এবং বদ্বীপ অঞ্চল থেকে লোকজন আসছিল, বিভিন্ন শহর, গ্রাম থেকে লোকজন এসে মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছিল। তিনি আল্লাহর কসম করে বললেন যে তিনি যখন ঐ গোরস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং কবরগুলো খোলা হচ্ছিল তখন এমন অনেক কবর ছিল যা থেকে এত সুন্দর ঘ্রাণ এসে তার নাকে লাগছিল যা তিনি আগে কখনো পাননি। তা ছিল এক অপরূপ সুবাস। তিনি আরও বলেন যে এমন অনেক কবরও ছিল যা থেকে কোনোরকম ঘ্রাণ আসছিল না। কিন্তু প্রতিটি কবরেই একটি বিষয়ে সাদৃশ্য ছিল। মৃতদেহগুলো অক্ষত ছিল এবং সহজেই বহন করা যাচ্ছিল, যেন কয়েক ঘন্টা আগে এদের কবর দেয়া হয়েছে। আল্লাহু আকবার! সেই অফিসার বলেন যে যদি ভুলবশত তারা কোনো ইয়াহুদীর কবর খুলে ফেলতেন, তা থেকে খুবই উৎকট গন্ধ বের হতো। তারা যত দ্রুত সম্ভব কবরটি আবার মাটিচাপা দিয়ে দিতেন। 


৬ অক্টোবরের যুদ্ধে যেসব মিশরীয়রা যোগদান করেছিলেন তারা আল্লাহর মাহাত্ম্য বর্ণনা করছিলেন, রোজাদার ছিলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ ধ্বনি তুলছিলেন এবং শাহাদাতের সুধা পান করার জন্য অধির ছিলেন। আবর এবং মুসলিমদের সম্বিৎ ফিরিয়ে আনতে সেই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। মিশরের পরবর্তী শাসক, সাদাত, ইসলামি দলগুলোর সাথে সমঝোতা করতে চাইলো। তাই সে তাদের কারাগার থেকে মুক্ত করে দিল যাতে করে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ভারসাম্য থাকে, যারা কিনা মিশরে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। শারাউই এবং আল-বাসিওনি কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছিল এবং তাদের সাথে যুক্ত ছিল। ফিলিস্তিনেও জাগরণ ঘটতে শুরু হয়েছিল, বিশেষ করে গাজা উপত্যকায়, যার উপর মিশরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্রভাব পড়েছিল। মিশরে যখন জাগরণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো, গাজাও তা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিল। মিশর থেকে গাজার দূরত্ব কেবল কয়েক কিলোমিটার। 


শাইখ আহমাদ ইয়াসিন এই জাগরণের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তিনি সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (রহি.) রচিত তাফসীর ফী যিলালিল কুরআনের শেষ অধ্যায়টি নিলেন, এটি খুব বড় একটি অধ্যায় ছিল এবং কেউই তা পাঠ করেনি কারণ তখনও কোনো জাগরণ ছিল না। তিনি অধ্যায়টিকে চার-পাঁচটি ভাগে ভাগ করলেন এবং ফিলিস্তিনের ধনী ধার্মিক পরিবারগুলোর সাথে দেখা করে তাদের বললেন যত কপি সম্ভব প্রিন্ট করতে এবং যত বেশি সম্ভব লোকেদের মাঝে বিতরন করে দিতে যাতে করে লোকেরা কুরআনের সর্বশেষ পারার তাফসীর অধ্যায়ণ করতে পারে। তরুণরা তা পড়তে শুরু করলো এবং একত্রিত হতে শুরু করলো যাতে করে তিনি তাদের শিক্ষা দিতে পারেন এবং সাহায্য করতে পারেন। তিনি তাদের শিক্ষামূলক দারসে একত্রিত করলেন যাতে করে তারা কুরআন, হাদীস, সুন্নাহ, সীরাহ, মহান মুসলিম বীরদের জীবনী সম্পর্কে অধ্যায়ণ করতে পারে। তিনি তাদের আগলে রাখলেন যাতে তারা ইসলামের জন্য কাজ করতে পারে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে পারে। ১৩৯৬ হিজরিতে (১৯৭৬ সালে) শাইখ আহমাদ ইয়াসিন একটি শিক্ষাকেন্দ্র  হিসেবে ‘জামিআতুল ইসলামিয়্যা’ প্রতিষ্ঠা করেন যা দেখতে ছিল একটি ক্রিড়াকেন্দ্রের মতো। কারণ আপনারা সকলেই জানেন যে উপনিবেশের বাস্তবতা হলো লোকেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য একত্রিত হতে পারে না। সমাবেশটি দেখতে কোনো ক্রিড়া সংঘের মতো হলেও আসলে তা ছিল একটি শিক্ষাকেন্দ্র। 


এক বছর বাদে তিনি ইসলামিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলেন। এটি আজও ফিলিস্তিনের বুকে দাঁড়িয়ে আছে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অন্যতম প্রমাণ হিসেবে। ১৩৯৭ হিজরিতে (১৯৭৭ সালে) তিনি ইসলামিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ১৩৯৯ হিজরি (১৯৭৯ সাল) পর্যন্ত তার অনুমোদন দেয়নি। পর্যাপ্ত সরবরাহের অভাব সত্ত্বেও শাইখ আহমাদ ইয়াসিন লড়ে গিয়েছেন। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আজ আমাদের অনেকেই বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, টাকা ওড়াচ্ছে। কিন্তু শাইখ আহমাদ ইয়াসিন তেমন ছিলেন না, তিনি খুব গরীব ছিলেন। শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের (রহি.) এক কণ্যা বলেন, 

তিনি গৃহস্থালির টাকাও দান করে দিতেন। যখন তাঁর কাছে গৃহস্থালির টাকা চাওয়া হত তখন তিনি বলতেন, ‘ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন’।

দরিদ্রদের দানের ব্যপারে তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত। দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি এবং তাঁর বন্ধুরা ইসলামি সাদাকাহ প্রজেক্টে অর্থ দান করতেন। কিন্তু আজ আমাদের মিলিয়নিয়ারদের অবস্থা দেখুন। তারা যদি চায় তবে আল্লাহর সহায়তায় তাদের অর্থ দান করার মাধ্যমে দরিদ্রদের জীবন পরিবর্তন ঘটাতে পারে। কিন্তু তারা আজ কোথায়? শাইখ আহমাদ ইয়াসিন এবং তাঁর বন্ধুরা যতটুকুই জোগাড় করতে পেরেছেন তা দিয়েই অনেক কিছু করেছেন, অনেক মানুষকে সাহায্য করেছেন। 


শাইখ আহমাদ ইয়াসিন একটি মাসজিদে ইসলামিক একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে শিশুদের কুরআন শিক্ষার জন্য একটি নার্সারি ছিল। শাইখ ইয়াসিন (রহি.) কুরআনকে খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং কুরআন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টি ছিল। 


১৪০২ হিজরিতে ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননে সহিংস আক্রমণ চালায়, বৈরুত দখল করে এবং বা’বদার রিপাবলিকান প্যালেস অবরোধ করে। সেই সময় শাইখ আহমাদ ইয়াসিন এবং তাঁর সাথীরা আল্লাহর রাস্তায় সশস্ত্র জিহাদ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা খুব সক্রিয়ভাবে এবং দৃঢ়সংকল্পের সাথে জিহাদ শুরু করলেন। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন বলেন যে তাঁরা দু’টি বন্দুক কিনেছিলেন। তাঁরা কেবল দু’টি বন্দুক নিয়ে শুরু করেছিলেন, আর কিছু ছিল না! অন্য কিছু কেনার মতো টাকা ছিল না তাদের কাছে। তাই তাঁরা দু’টো বন্দুক কিনলেন এবং সেগুলোই ব্যবহার করতে শুরু করলেন। তাঁরা প্রশিক্ষণ এবং জিহাদের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ১৪০৩ হিজরিতে (১৯৮৩ সাল) তাঁরা ধরা পড়ে গেলেন এবং শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে গ্রেফতার এবং আটক করা হলো। তারা তাঁকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিল। এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় কারাবরণ। প্রথমবার ইখওয়ানের সাথে গাজায় তিনি কারাবরণ করেছিলেন। সেটি ছিল ১৩৮৫ হিজরি (১৯৬৫ সাল)। তখন তাঁকে এক মাস আটক করে রাখা হয়েছিল। যারা আল্লাহ রাস্তায় দাওয়াত দেয়, আল্লাহ রাস্তায় জিহাদ করে তাদের সকলকেই আল্লাহ পরীক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন,  


الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾ اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَکُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ ہُمۡ  لَا یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۲﴾  لَقَدۡ فَتَنَّا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ فَلَیَعۡلَمَنَّ اللّٰہُ  الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ  الۡکٰذِبِیۡنَ 

আলিফ-লাম-মিম। মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।” [আল-‘আনকাবূত : ০১-০৩]


তো শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে আটক করা হলো এবং অস্ত্র ব্যবহার এবং বিক্রয়ের দায়ে ১৩ বছরের সাজা দেয়া হলো। ইজরায়েলিরা যাকে যেমন ইচ্ছা অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে। এটা তাদের জন্য কোনো ব্যপারই না। শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের গ্রেফতারের প্রায় এক বছর আগে ইজরায়েলের লেবানন দখলের সময় প্রতিরোধ আন্দোলনের লোকেরা বৈরুতে তিন ইজরায়েলি সৈন্যকে বন্দী করে। পরবর্তীতে প্রতিরোধ আন্দোলন ঐ তিন ইসরায়েলি সৈন্যের বিনিময়ে ১২০০ ফিলিস্তিনির মুক্তি দাবি করল। আল্লাহু আকবার! এ থেকে বোঝা যায় যে তাদের কাছে আমরা একেবারেই মূল্যহীন। তিন ইসরায়েলি সৈন্যের বিনিময়ে ১২০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়া হলো। এবং আল্লাহর রহমতে শাইখ আহমাদ ইয়াসিন তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আরেক লোক ছিল যে কিনা ১৮ বছর জেল খেটেছে, কিন্তু তাকে মুক্তি দেয়া হলো না কারণ লিস্টে তার নাম ছিল না। কিন্তু শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে (রহি.) আটকের ১১ মাস পরেই মুক্তি দেয়া হলো। আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোক যে কিনা অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতেও পারে না, সে কীভাবে কারাগারে বেচেঁ থাকতে পারে? চিন্তা করে দেখুন এরকম একজন ব্যক্তির জন্য কারাগার কতটা কঠিন হতে পারে! কিন্তু তাঁর ছিল ধৈর্য এবং ইস্পাত কঠিন ইচ্ছাশক্তি। শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে (রহি.) মুক্তি দেয়া হলো। ফিলিস্তিনি বিপ্লবের কথা শুনে সারা বিশ্ব অবাক হয়ে গেল। এই বিপ্লব ঘটেছিল ১৪০৭ হিজরিতে (১৯৮৭ সালে)। এর সূচনা হয়েছিল ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর। ঐ সময়ও ইজরায়েলিরা ভেবেছিল যে তাদের কর্তৃত্ব আছে এবং তাদের বিজয় নিশ্চিত। তারা ভেবেছিল যে ইসলামি প্রতিরোধ বিলুপ্ত হয়ে গেছে যেহেতু তার অনেক নেতা এবং সদস্য কারাগারে বন্দী। তাই ফিলিস্তিনি বিপ্লব সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। উদ্ধত এক ইয়াহুদী ট্রাক চালিয়ে একটি ছোট গাড়িকে গিয়ে আঘাত করল, গাড়িতে চারজন ফিলিস্তিলি শ্রমিক ছিল এবং প্রত্যেকেই মারা গেল। সকলেই জানত যে এটি ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত ইচ্ছাকৃত দূর্ঘটনা। তাই লোকেরা ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠল। বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল মাসজিদগুলো থেকে এবং বিজ্ঞ লোকেরা জনগণের ক্রোধকে একটি নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত করছিলেন। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন (রহি.) তার বিজ্ঞ সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি জানতেন কীভাবে কোনো ঘটনা থেকে ফায়দা নিয়ে তা ইসলাম এবং মুসলিমদের সাহায্যে কাজে লাগানো যায়। ফিলিস্তিনিরা একমত হয়ে ঐ বছরের প্রথম বিপ্লব সম্পর্কিত দাবি পেশ করলো। এক মাস বাদে ১৯৮৮-র ৮ জানুয়ারি ফিলিস্তিনিরা আরেকটি দাবি পেশ করল। তারা প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাইলো। কারণ যারা অগ্রগামী হবে, প্রথমে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং ইসলামি ও ফিলিস্তিনি অঞ্চলে প্রবেশ করবে তারাই ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করবে। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তা-ই ঘটলো। ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন ‘হামাস’ প্রতিষ্ঠিত হলো। যেমনটি আমি বলেছিলাম, এটি হলো আজ ফিলিস্তিনের সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলন। সকল শুকরিয়া আল্লাহর। 


আল্লাহর ইচ্ছায় শাইখ আহমাদ ইয়াসিন হামাসের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি অনেক সফল অপারেশন পরিচালনা করেছেন যা তখন ইয়াহুদীদের এবং ইয়াহুদী সমাজকে চমকে দিয়েছিল। ইজরায়েলিরা ভেবেছিল যে প্রতিরোধ আন্দোলন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বিশেষ করে ১৩৯০ হিজরির (১৯৭০ সালের) কালো সেপ্টেম্বরের ঘটনাসমূহ এবং ১৪০২ হিজরির (১৯৮২ সালের) বৈরুতের ঘটনাসমূহের পর। ইজরায়েলিরা ভেবেছিল যে তারা প্রতিরোধ আন্দোলনকে বিলীন করে দিয়েছে, তাই হামাসের জাগরণে তারা হকচকিয়ে গিয়েছিল, যেহেতু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম ইসলামি গণজাগরণ ছিল। এরপর ধীরে ধীরে এই আন্দোলন আরও প্রসার লাভ করলো, সকল প্রসংশা আল্লাহর। ১৪০৮ হিজরিতে (১৯৮৮ সালে) ইয়াহুদীরা খোলাখুলিভাবে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে হুমকি দিল, বিশেষ করে মারজ আল-যুহুর অপারেশনের পর। ৪০০ ফিলিস্তিনিকে লেবাননে নির্বাসিত করা হলো এবং পরবর্তীতে ফেরত যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। ১৪০৯ হিজরিতে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে (রহি.) আবারও আটক করা হলো এবং ২৫ বছরের সাথে আরও ১৫ বছর কারাদণ্ড দেয়া হলো। অর্থাৎ, ২৫ বছরের পর আরও ১৫ বছর তাঁকে কারাভোগ করতে হবে, মোট ৪০ বছর তাঁকে কারাগারে থাকতে হবে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সাড়ে আট বছর পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলো। আল্লাহু আকবার! শাইখ ইয়াসিন তার শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে সাড়ে আট বছর কারাবাস করেছেন। ১৪১৭ হিজরিতে দুই ইজরায়েলি এজেন্টের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ঐ দুই এজেন্ট জর্ডানে উস্তাদ খালিদ মিশালকে (হাফি.) হত্যাচেষ্টা চালিয়েছিল। এক সাহসী ব্যক্তি ঐ দুই এজেন্টকে পাকড়াও করেন, তখন তিনি শাইখ খালিদ মিশালের সাথে ছিলেন। খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও ঐ ব্যক্তি সাহসীকতার সাথে এজেন্টদ্বয়ের পিছু নেন এবং উভয় এজেন্টকেই পাকড়াও করেন। ইজরায়েল বাধ্য হয়ে ঐ দুই এজেন্টের বিনিময়ে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে মুক্ত করে দেয়। এই বিনিময় ঘটিয়েছিলেন এবং শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন কিং হুসেইন। জর্ডানের আম্মানে কিং হুসেইন নিজে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ইয়াসির আরাফাতও আম্মানে তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। 


চলুন দেখি শাইখ আহমাদ ইয়াসিন কারাগারে কি করেছিলেন। হাড় কাপাঁনো ঠান্ডা এবং সেই সাথে গরম আবহাওয়া তাঁকে প্রভাবিত করেছিল, তাঁর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কারাগারে তিনি খুব কঠিন সময় পার করেছিলেন। কিন্তু কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তিনি আন্তরিকভাবে কুরআন হিফয করতে সক্ষম হয়েছেন। পূর্বে তিনি কুরআনে অনেক অংশই হিফয করেছিলেন, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ কুরআন হিফয করা শেষ করেন ১৪১০ হিজরিতে (১৯৯০ সালে)। তিনি প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করতেন। যখন তাঁকে জোরপূর্বক সকলের থেকে আলাদা করে রাখা হতো তখন যা তিলাওয়াত করতেন তা থেকেই শিখতেন। কারাগারে থাকাকালীন তিনি কান্না বা হাহুতাশ করেননি এবং মনোবল হারাননি। তিনি কারাগারে সাড়ে আট বছর ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়, তিনি তখন একজন বৃদ্ধ মানুষ। আর আপনারা তো তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জানেন। কিন্তু তিনি কারাগারে থেকেও স্বস্তি অনুভব করেছেন। তিনি নিয়মিত সুন্নাহ এবং ফরজ সালাতে মোট চার পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন ইমাম আন-নববীর মাজমু-ও পড়েছেন। তিনি শাফেঈ মাযহাবের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদী অধ্যয়ণও শেষ করেছেন। তিনি ইসলামি বই পড়তে ভালোবাসতেন এবং সেসময় তার অন্তর খুবই পবিত্র হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁর দ্বীনি কাজ তাঁর সহকারীদেরকে সামলাতে দিয়ে গেলেন এবং সাড়ে আট বছরের জন্য হামাসকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলেন। তাঁর মুক্তির সময় এক চমৎকার ঘটনা ঘটলো। ইজরায়েলিরা এসে তাঁকে বললো যে তাঁকে দ্রুত আম্মানে যেতে হবে। তিনি তখনও বন্দী বিনিময়ের ব্যপারে জানেন না। তিনি বললেন যে তারা যদি তাঁকে গাজায় নিয়ে যাওয়ার ওয়াদা না করে তবে তিনি কিছুতেই যাবেন না। সুবহানাল্লাহ! সেখানে তিনজন ইসরায়েলি অফিসার ছিল, দু’জন ব্রিগেডিয়ার ও একজন ক্যাপ্টেন। তারা ওয়াদা করবেনা, আর তিনিও যাবেন না, প্রায় নয় বছর পরিবার এবং সন্তান-সন্ততির থেকে দূরে থাকার পরেও। মাশাআল্লাহ, তাঁর মোট এগারোজন সন্তান-সন্ততি ছিল, আটজন কন্যা এবং তিনজন পুত্র। তাঁর মোট ৪০ জন নাতি-নাতনি ছিল। মাশাল্লাহ, ফিলিস্তিনি শিশুর সংখ্যা ইয়াহুদীদের ভয় পাইয়ে দেয়! তাঁর ২৩ জন নাতি ছিল। এ থেকেই সেসকল লোকের উপর আল্লাহর রহমত এবং সুরক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও ইয়াহুদীরা অনেক মানুষ মারে, কিন্তু আল্লাহ শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে, সেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিকে এমন বড় একটি পরিবার দিতে চাইলেন, আল্লাহ তাদের রহম করুন। তিনি তাঁর সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনিদের দেখতে চাইলেন, কিন্তু যতক্ষণ না তাঁকে গাজায় ফিরিয়ে দেয়ার কথা দেয়া হচ্ছিল ততক্ষণ তিনি যাবেন না। তাঁর ভয় হচ্ছিল যে তাঁকে হয়তো জর্ডনে আটক করা হবে এবং সেখানে থাকতে বাধ্য করা হবে। শেষমেশ তারা লিখিত অঙ্গীকার দিতে রাজি হয়েছিল। তিনি তাঁর সাথীদেরও মুক্তি দিতে বললেন। দেখুন তিনি কতটা দরদী। তিনি সেই দুইজনের কথা ভুলে যাননি যারা তাঁর সঙ্গে ছিল এবং তাঁর খেয়াল রেখেছিল। তাদের একজনকে ১২ বছরের সাজা দেয়া হয়েছিল সে ৩ বছর কারাভোগ করেছে এবং অপরজনকে ৮ বছরের সাজা দেয়া হয়েছিল সে ৫ বছর কারাভোগ করেছে। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন একা যেতে নারাজ৷ তারা তাঁর শর্ত মানতে রাজি হচ্ছিল না, তাই তিনিও যাচ্ছিলেন না। তাঁর ইযযাহ এবং মাহাত্ম দেখুন। ইসরায়েলিরা প্রথমবার এমন ইযযাহ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে দেখছে। মুসলিমদের আত্মসম্মান থাকা উচিত, দুনিয়াবি পদমর্যাদা, টাকা বা জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটা উচিত না। মর্যাদা লাভের জন্য তাদের উচিত নিজেদের ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করা। ইজরায়েলিরা শাইখ ইয়াসিনের সাথীদের মুক্তি দিতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ বোঝাপড়ার পর তারা ঐ ব্যক্তিকে ছাড়তে রাজি হলো যে তার ৮ বছরের মধ্যে ৫ বছর সাজা সম্পন্ন করেছে। তার আর ৩ বছর বাকী ছিল। তাকে শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের সাথে মুক্তি দেয়া হলো।


শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের অন্যতম গুণ হলো তাঁর মূল্যবোধ এবং ইসলামি ঐতিহ্যের আপস না করেই অধিক নমনীয়তা। তিনি শক্তমাথার ব্যক্তি ছিলেন না, বাতাসের দিকে তিনি ঝুঁকে যাবেন যতক্ষণ না তা শেষ হয়ে যায় এবং তারপর তিনি আবার কাজ শুরু করবেন। জর্ডানে এসে ইসরায়েলিরা তাঁকে বিমান থেকে নামতে বললো, কিং হুসেইন বাইরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তিনি তাদের কাছে তার আইডি কার্ড চাইলেন। তাঁরা বললো যে তাদের কাছে নেই। তিনিও আইডি কার্ড ছাড়া বিমান থেকে নামবেন না। তারা তাঁর আইডি কার্ডটি নিয়ে নিয়েছিল যাতে করে তিনি আর ফেরত যেতে না পারেন। বাধ্য হয়ে তারা তাঁর আইডি কার্ড তাকে ফিরিয়ে দিল। এবার তিনি তাঁর লিখিত অঙ্গীকার চাইলেন। তারা তাঁকে একটি নকল অঙ্গীকারনামা দিল যাতে কোনো সাক্ষর ছিল না। তিনি সাক্ষর ছাড়া অঙ্গীকারনামা নেবেন না। তারা গিয়ে তা সাক্ষর করে আনলো। 


তাঁর মুক্তি কেবল তার জন্যই নয় বরং ফিলিস্তিন বা যেকোনো দেশের মুজাহিদদের জন্য সম্মানের কারণ ছিল। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন গাজায় ফিরে গেলেন। তিনি বলেন যে যখন তিনি দেখলেন তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য হাজার হাজার মানুষের ভিড়, তা দেখে তিনি কেঁদে দিলেন। তিনি চিন্তাও করেননি এত লোক তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য আসবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তিনি কে এবং তিনি কি এমন করেছেন যার জন্য তিনি এটা পেলেন। দেখুন গণজাগরণের জনক, হামাসের প্রতিষ্ঠাতা এবং ফিলিস্তিন ইখওয়ানের প্রধান নিজের ব্যপারে কতটা নিরহংকারভাবে কথা বলছেন এবং তাকে স্বাগত জানানোর দিনে কেঁদেছেন। প্রতিনিধিদের দল একমাস যাবত তাঁর সাথে দেখা করতে আসছিল, এবং তিনি তাদের সাথে দেখা করছিলেন। তিন-চার বাস ভর্তি লোক তাঁর বাসায় আসতো তাঁর সাথে দেখা করার জন্য, তবুও তিনি বিরক্ত হতেন না। 


১৪১৭ হিজরি থেকে তাঁর শাহাদাতের আগ পর্যন্ত শাইখ আহমাদ ইয়াসিন ফিলিস্তিনের জন্য একাগ্রভাবে লড়ে গিয়েছেন এবং তাঁর সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। যেদিন তিনি মারা গেলেন, সেদিন ছিল সোমবার, তিনি সেদিন রোজা রেখেছিলেন। তিনি আল্লাহর সুরক্ষায় ফজরের সালাত জামাআতে আদায় করতে গেলেন। 

যে ফজরের সালাত জামাআতে আদায় করবে সে আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকবে। আর আল্লাহ যদি ঐ ব্যক্তিকে নিরাপত্তা প্রদানের হক কারো থেকে দাবী করে বসেন তাহলে সে আর রক্ষা পাবে না। [সহীহ মুসলিম (ইসলামী ফাউন্ডেশন) : ১৩৬৭] 

তিনি জামাআতে ফজরের সালাত আদায় করলেন এবং সকালের তাওবাহ করলেন এবং ঐ দিন রোজা রাখলেন। মাসজিদ থেকে ফেরার পথে ইজরায়েলি মিসাইল এসে তাকে আঘাত করে। মহিমান্বিতভাবে তার ইহজীবনের সমাপ্তি ঘটলো। জীবন এবং মৃত্যু উভয়েই সম্মানিত হওয়াই তো আসল মর্যাদা—যেমন বলেছিলেন আবুল হাসান আত-তিহামী (রহি.) যখন তিনি তাঁর দেশের এক মন্ত্রীর প্রশংসা করছিলেন। আমরা আজ এমন এক মহান ব্যক্তির প্রশংসা করছি যিনি নিজের দেশের জন্য, নিজের ধর্মের জন্য এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য আন্তরিকভাবে লড়ে গেছেন। আহমাদ ইয়াসিন মুসলিমদের একতাবদ্ধ করার জন্য অনেক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও তিনি অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, বিশেষ করে যখন তাঁরা তিউনিসিয়া থেকে ফিরলেন। যখন গাজায় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো তার আগে ফিলিস্তিনে সকল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সেক্যুলার। পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থীদের মেলামেশা ছিল সাধারণ বিষয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোনো ধর্মীয় বিধান মানা হতো না। শাইখ ইয়াসিন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পবিত্র করতে চাইলেন, পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে একটি সুষ্ঠু পাঠ্যক্রম পরিচালনা করতে চাইলেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিলেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। ফিলিস্তিনের কর্তৃপক্ষ তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের নির্বাচিত লোকদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে চাইলো, কিন্তু শাইখ ইয়াসিন অন্যদের নিয়োগ দিতে বদ্ধপরিকর। মুহাম্মাদ শাকর নামের একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। আল্লাহ চাইলেন মুহাম্মাদ শাকর ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদে বহাল থাকবে। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন অধ্যাপককে গুপ্তহত্যা করা হলো। কিন্তু শাইখ ইয়াসিন ধৈর্য ধারন করলেন এবং নিজের, নিজের সাথীদের বা ফিলিস্তিনের ইসলামি গণজাগরণকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চাইলেন না। মূলত তিনি ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু। তার জীবদ্দশায় তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতা করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষ করে তাঁরা তিউনিসিয়া যাওয়ার আগে এবং পরে। তাঁরা তিউনিসিয়া থেকে ফেরার পর তাঁকে খুব জ্বালাতন করা হয়, কিন্তু তিনি চুপ থেকে সকল বাধা সয়ে নেন। তিনি খুব উঁচু পর্যায়ের ধৈর্যশীল ছিলেন। এক বিপদসংকুল সময়েও তিনি তার অধীনস্থ লোকদের অটল রেখেছেন এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ফিলিস্তিনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, কিন্তু শাইখ ইয়াসিন খুবই ধৈর্যশীল ছিলেন এবং অনেক বড় বড় সমস্যাও দমন করেছেন। তিনি অনেকবার নিজেকে এবং তার লোকদের প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত রেখেছেন এবং এই কারণেই তিনি নিজের লোকেদের এবং অন্যদের ভালোবাসা লাভ করেছেন। মূলত মানুষের ভালোবাসা লাভ করা আল্লাহর এক কৃপা। ইমাম বুখারী তার হাদীস গ্রন্থে একটি বিখ্যাত হাদীস বর্ণনা করেন, 

আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জিব্রিলকে (আ.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি। সুতরাং, তোমরাও তাকে ভালোবাসো।’ তখন জিব্রিলও (আ.) ঐ বান্দাকে ভালোবাসেন। ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করেন না, তাদের যা আদেশ করা হয় তারা তা-ই করেন। এরপর জিব্রিল (আ.) আসমানে ঘোষণা করে দেন, ‘আল্লাহ তাঁর অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তাই তোমরাও তাকে ভালোবাসো’। ফলে আসমানের অধিবাসীরাও ঐ বান্দাকে ভালোবাসেন এবং দুনিয়াতেও তাকে সম্মানিত করা হয়।


আমরা শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে শ্রদ্ধা করি এবং আল্লাহই তাঁর বিচারক। আমাদের ধারণা, তিনি আল্লাহর ফেরেশতাগণের ভালোবাসা লাভ করেছেন এবং দুনিয়ায়ও ভালোবাসা পেয়েছেন। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন লোকদের সমর্থন এবং ভালোবাসা লাভ করেছিলেন কারণ তিনি ছিলেন ধৈর্যশীল এবং তিনি ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝড়তে দেননি। মহান ব্যক্তিরাই এমন কষ্ট সহ্য করতে পারেন। তিনি খুব দয়ালু চরিত্রের ছিলেন। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে তিনি অনেকবার আটক হয়েছেন এবং মৃত্যুর মাসখানেক আগে অনেকবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালালো হয়েছিল। এত কিছু সত্ত্বেও তিনি ছিলেন দয়ালু। তিনি এক মহিলার ভরনপোষণ করতেন যার ১৪ জন পুত্র ছিল এবং তাদের সাহায্যের জন্য কোনো পরিবারও ছিল না। তাঁর পক্ষাঘাত এবং অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি ঐ মহিলার সাথে দেখা করতে যেতেন, সেই মহিলার বা তার ছেলেদের কিছু দরকার আছে কিনা তা জানার জন্য। যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যকে আটক করা হয়েছে, তারা তাঁর কাছে আসতো, তাদের খাবার বা টাকাপয়সা থাকতো না এবং তিনি তাদের যা দরকার তা দিতেন। তিনি দরিদ্র, অভাবগ্রস্থ, ইয়াতিম এবং বিধবাদের সাহায্য করতেন। তিনি খুবই দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। আপনি হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যে তিনি কীভাবে এত লোককে সাহায্য করতেন। তাঁর কন্যা বলেন,

তিনি গৃহস্থালির অর্থ গরীবদের দান করে দিতেন এবং বলতেন যে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।

তার কন্যারা বলেন যে তারা তাঁর মুখ থেকে রাগান্বিত কোনো শব্দ শোনেননি। তাঁর আটজন কন্যা ছিল। এতসংখ্যক কন্যার বাবা তাদের নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত বোধ করবেন৷ যেসকল পিতার অনেক কন্যা সন্তান আছে তারা বিষয়টি ভালো বুঝবেন, কারণ তারা তাদের কন্যাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তাদের বিয়ে, তাঁর মৃত্যুর পর তাদের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করেন। যার অনেক কন্যা সন্তান আছে তিনি জানেন। কিন্তু শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের কন্যারা বলেন যে তারা কখনো তাঁর মুখে এমন কোনো শব্দ শোনেননি যাতে মনে হয় তিনি তাদের উপর রাগান্বিত বা তিনি তাদের উপর অসন্তুষ্ট। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন মোহরানা সহজ করে দিয়ে তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এক ব্যক্তি শাইখ ইয়াসিনের এক কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। তিনি ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন যে তাঁর সাথে এখন কত টাকা আছে এবং সেই পরিমাণ অর্থই মোহরানা ধার্য করলেন। এক ব্যক্তি শাইখ আহমাদ ইয়াসিনকে মোহরানা হিসেবে কিছু টাকা দিলো এবং তিনি ঐ ব্যক্তিকে সাহায্য করার জন্য তার চেয়ে বেশি টাকা ফেরত দিলেন! শাইখ আহমাদ ইয়াসিন (রহি.) এমনই ছিলেন। অর্থাৎ, তার জীবনে মানবীয় অনেক ঘটনা ছিল। তিনি দুঃখ পেতেন এবং রাগান্বিত হতেন যখন অন্যরা তাদের ভোগবিলাস নিয়ে আনন্দিত হতো। আহমাদ ইয়াসিন একজন অক্ষম ব্যক্তি ছিলেন, তিনি তাঁর ডান চোখে একেবারেই দেখতে পেতেন না, এবং বামচোখে ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন। তিনি দীর্ঘমেয়াদী ওটিটিসে ভুগেছিলেন। তিনি ছিলেন অক্ষম এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত, তবুও পৃথিবীতে তার বিরাট প্রভাব ছিল। পৃথিবীর সকল সরকার তাঁকে সম্মান করত। পৃথিবীর মহান মহান ব্যক্তিরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। আরব এবং ইসলামি বিশ্বে তার সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্ব বহণ করত এবং সারা পৃথিবীতে তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কীভাবে বিকলাঙ্গ একজন ব্যক্তি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন? কারণ তিনি আল্লাহকে মান্য করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন, তাই আল্লাহ সকলকিছুকে তাঁর সেবায় নিয়োজিত করলেন এবং তাঁর জন্য সহজ করে দিলেন। যেদিন তিনি ইসলাম সম্পর্কে জানলেন এবং এর সেবায় নিয়োজিত হলেন সেই থেকে তার শাহাদাত পর্যন্ত শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের (রহি.) জীবন ছিল মহান কাজের এক ধারাবাহিক প্রবাহ। 


দেখলেন মহান ব্যক্তিদের জীবনের পরিসমাপ্তিও সবসময় কেমন মহিমান্বিত হয়? তারা যখন জীবিত থাকে, তারা তাদের বন্ধুদের স্বস্তির কারণ হয় এবং তাদের মৃত্যু শত্রুদের জ্বালার কারণ হয়। এটাইতো শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সম্মানের জীবন। কিন্তু যারা অপমানিত হয়ে বাঁচে এবং মরে তারা আদৌ জীবিত নয়। যারা ইঁদুরর মতো পালিয়ে, লুকিয়ে বেড়ায়, তাদের জীবনে কোনো সম্মান নেই। সেই ব্যক্তির জীবন সম্মানিত এবং মহিমান্বিত যে মাসজিদ থেকে ফজরের সালাত আদায় করে বের হয় এবং তার অক্ষমতা সত্ত্বেও প্রাণঘাতী মিসাইল এসে তাকে আঘাত করে। আমাদের কাছে ঐ ব্যক্তি একজন শহীদ বলে গণ্য হবেন এবং আল্লাহই তার বিচারক। এ তো এক চমৎকার জীবন যা আসলেই মহিমান্বিত, ইসলামের সেবায় বিভিন্ন কাজ দ্বারা পরিপূর্ণ। শাইখ আহমাদ ইয়াসিন বলেন যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর হাতে কোনো অবসর সময় ছিল না। তারপরও তিনি তার কন্যা এবং জামাতাদের সাথে সময় কাটিয়েছেন, তাদের যতটা সম্ভব সময় দিয়েছেন। যদিও আমরা শুনেছি যে তাঁর কাজের দরুন তার কন্যারা দীর্ঘদিন তাঁর দেখা পেত না। 


এই মহান ব্যক্তি আমাদের অনুসরণীয় এক উদাহরণ হওয়া উচিত। একজন অক্ষম ব্যক্তি যদি এতকিছু করতে পারেন তবে একজন সক্ষম ব্যক্তি কতটা করতে পারবে? আমরা যেন আমাদের দ্বীনের সেবা করাকে এবং এর জন্য কাজ করাকে এড়িয়ে না যাই বা এর কল্যাণে লড়া এবং অবদান রাখা বন্ধ না করে দিই। অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও শাইখ আহমাদ ইয়াসিন অনেক কিছু অর্জন করেছেন এবং দ্বীনের জন্য চমৎকার সব কাজ করেছেন। সুতরাং আমরা এই দ্বীনের জন্য কি করতে পারি, তাঁর রুহের স্বস্তির কারণ হতে পারি এবং ইনশাআল্লাহ জান্নাতে যখন তার সাথে মিলিত হব তখন তাঁর স্বস্তির জন্য কি করতে পারি? আমরা শাইখ ইয়াসিনের কাজকে চালিয়ে যেতে পারি এবং আল-আকসায় সালাত আদায়ের জন্য তা মুক্ত করার রাস্তা খুঁজতে পারি, বিইযনিল্লাহ। এটাই শাইখ ইয়াসিনের আকাঙ্খা ছিল। তিনি সেই ব্রিগেড গঠন করেছিলেন যা ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে যাবে যতক্ষণ না ফিলিস্তিন মুক্ত হচ্ছে, এর নামকরণ করা হয়েছে মুজাহিদ ইযয আদ-দ্বীন আল-কাসসামের নামানুসারে। আল্লাহর রহমতে এই বিগ্রেডগুলো বীরত্ব দেখিয়েছে। তাই এখন আমাদের কাজ হলো এই লড়াইকে এগিয়ে নেওয়া এবং শাইখ আহমাদ ইয়াসিন যা শুরু করেছিলেন তা অব্যহত রাখা। আমাদের উচিত তার উদাহরণ অনুসরণ করা এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা চালানো। শাইখ আহমাদ ইয়াসিনের মতো সম্মান অর্জনে কাজ করা, এবং দু'আ করা যেন আমরাও শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করতে পারি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছু করতে সক্ষম। সালাত এবং সালাম বর্ষিত হোক রাসূল মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর পরিবার এবং সাহাবাগণের উপর। সকল প্রশংসা বিশ্বজাহানের মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার।


[শাইখ মুহাম্মাদ মূসা আল-শারীফের লেকচার অবলম্বনে]

Post a Comment

0 Comments