আমেরিকা কেন ইসরায়েলকে সমর্থন করে?—এর পেছনে একটি দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয় ইতিহাস আছে। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা উচিত, খ্রিস্টান-যায়োনিজম খুবই ক্ষমতাবান একটি শক্তি। যার সূচনা ইহুদি-যায়োনিজমেরও অনেক আগে। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে খ্রিস্টান-যায়োনিস্টরা ছিল ব্রিটিশ অভিজাতদের মধ্যকার একটি ক্ষমতাসীন দল। ব্যালফোর ঘোষণা (Balfour Declaration) এবং ইসরায়েলে ইহুদি উপনিবেশে ব্রিটেনের সমর্থনের পেছনের যেসব বল কাজ করেছে সেগুলোর একটি ছিল খ্রিস্টান-যায়োনিজম। বাইবেলে কী বলা আছে তা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন।
ব্রিটিশ অভিজাত সংস্কৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল এই খ্রিস্টান-যায়োনিজম। আমেরিকায়ও একই অবস্থা। উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। তিনি প্রতিদিন বাইবেল পড়তেন। হ্যারি ট্রুম্যান (Harry S. Truman)-ও এমন ছিলেন। রুজভেল্ট (Roosevelt) প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের একজন, হ্যারল্ড ইকিস (Harold Ickes) একবার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ফিরে যাওয়াকে ইতিহাসের বৃহত্তম ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এটা বাইবেল পড়ে সহজেই বোঝা যায়।
অত্যন্ত ধার্মিক এই দেশগুলোয় ‘বাইবেলের নির্দেশ’ বেশ আক্ষরিকভাবে নেয়া হয়। এছাড়াও, এটি উপনিবেশ স্থাপনের একটি অংশ মাত্র। এটি ইউরোপীয় উপনিবেশের শেষ পর্যায়। লক্ষ্য করুন, ইসরায়েলের দৃঢ় সমর্থক কিন্তু কেবল আমেরিকা নয়, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডাও আছে। এগুলো ইংল্যান্ডেরই শাখা-প্রশাখা। এগুলো অ্যাংলোস্ফিয়ার (Anglosphere) নামেও পরিচিত। এগুলো সাম্রাজ্যবাদের অস্বাভাবিক রূপ। এগুলো হলো দখলদার কলোনিয়াল সমাজ। এই সমাজ ভারতের মতো নয়... ভারতের ব্রিটিশ উপনিবেশের মতো নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা কিছুটা এমন দখলদার কলোনিয়াল সমাজ ছিল, বা ফরাসিদের অধীনে আলজেরিয়া এমন ছিল।
দখলদার কলোনিয়াল সমাজগুলোয় মূলত বসতি স্থাপনকারী বা দখলদাররা সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব মুছে ফেলে। এরা মূলত ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়... খ্রিস্টান-যায়োনিজম দ্বারা পরিচালিত অত্যন্ত ধর্মীয় গোষ্ঠী এরা। এগুলো হলো প্রধান কিছু সাংস্কৃতিক ফ্যাক্টর।
এছাড়াও উল্লেখযোগ্য জিওস্ট্র্যাটেজিক ফ্যাক্টরও রয়েছে। আপনি ১৯৪৮ এ ফিরে যান—নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের ব্যাপারে আসলে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তা নিয়ে তখন আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং পেন্টাগনের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রতি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিল না। তারা শরনার্থী সমস্যাটি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিল এবং এর একটি বাস্তবমুখী সমাধান চাচ্ছিল। অন্যদিকে, পেন্টাগন ছিল এর বিপরীত। ইসরায়েলের সামরিক সম্ভাবনা এবং সাফল্য দেখে রেকিট খুব মুগ্ধ হয়েছিল।
আপনি যদি ডিক্লাসিফাইড ইন্টার্নাল রেকর্ডটির দিকে তাকান, তবে দেখবেন তৎকালীন জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফ ইজরায়েলকে তুরস্কের পরে ঐ অঞ্চলে দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি হিসেবে এবং ঐ অঞ্চলে আমেরিকান সেনাবাহিনীর একটি সম্ভাব্য ঘাঁটি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সেখানে আরও অনেক কিছু বলা ছিল, পুরো রেকর্ডটি এখন বর্ণনা করা সম্ভব না।
১৯৫৮ সালে যখন ঐ অঞ্চলে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়, তখন ইসরায়েলই একমাত্র রাষ্ট্র ছিল যা দৃঢ়ভাবে ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছিল। আর এই কারণে ইসরায়েল সেসব দেশের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর প্রচুর সমর্থন অর্জন করেছিল। ইসরায়েলের সাথে আমেরিকার বর্তমান সম্পর্ক বেশ পাকাপোক্ত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। ইসরায়েল তখন আমেরিকার প্রধান শত্রু সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করার মাধ্যমে আমেরিকার খুব বড় উপকার করেছিল। ইসরায়েলও তখন আমেরিকার মতো মৌলবাদী ইসলামকে সমর্থন করেছিল।
ইসরায়েল-আমেরিকা সম্পর্ক আজ অবধি অব্যাহত আছে। আমরা এর একটি উদাহরণ দেখতে পেয়েছিলাম গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণের সময়। সকল প্রকার যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত থাকার পরেও তখন এক পর্যায়ে গিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধাস্ত্র শেষ হতে শুরু করে। আমেরিকা তখন পেন্টাগনের মাধ্যমে ইসরায়েলকে অতিরিক্ত যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এবং লক্ষ্য করুন সেই যুদ্ধাস্ত্রগুলো কোত্থেকে নেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধাস্ত্রগুলো ইসরায়েলে আগে থেকেই ছিল, যেন প্রয়োজনে আমেরিকান সেনাবাহিনী সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। ইসরায়েলকে আমেরিকা যে এর একটি সামরিক শাখা মনে করে এটি তার অন্যতম লক্ষণ। আমেরিকা এবং ইসরায়েলের মধ্যে অনেক আগ থেকেই গোয়েন্দা সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এছাড়াও অন্যান্য অনেক সংযোগ তো আছেই।
মিডিয়াও ছোটোখাটো দুয়েকটা প্রশ্ন করা ব্যতীত সরকারের এই নীতিকে এপ্রকার সমর্থনই করে। উদাহরণস্বরূপ, ইরাকে আমেরিকার আক্রমণকে ধরুন। আমেরিকার মিডিয়াতে আপনি “ইরাকে আমেরিকার আগ্রাসন” কথাটি খুঁজেই পাবেন না। কিন্তু এটি স্পষ্টতই একটি আক্রমণ ছিল। আগ্রাসনের একটি নির্মম ধরণ। বিষয়টি খোলা বইয়ের মতো স্পষ্ট ছিল। নূরেমবার্গ ট্রায়ালে একে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এগুলোর কোনো উল্লেখ আপনি আমেরিকান মিডিয়ায় পাবেন না।
এই আক্রমণের বিরোধিতা করার জন্য রাষ্ট্রপতি ওবামা প্রশংসিত হয়েছিলেন। তিনি কি বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, এটি একটি ভুল। একটি কৌশলগত ভুল। আমরা এর পরিনতি থেকে রক্ষা পাবো না। হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের সময় আপনি জার্মান জেনারেল সেক্রেটারিদেরকে এমন বিরোধিতা করতে শুনেছেন। “এটি একটি ভুল। আমাদের এটা করা উচিত না। ইংল্যান্ডকে প্রথমে আক্রমণ করা উচিত” ইত্যাদি।
ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসনের বিষয়টাও একই। এখন ভিয়েতনামে আমেরিকান সেনাবাহিনীর বিসর্জন নিয়ে একটি বড় স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। “দক্ষিণ ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসন” কথাটি আমেরিকার মিডিয়ায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন! ১৯৬১ সালে যখন এই আগ্রাসনের সূচনা হয়েছিল সেসময় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সময় কোনো মিডিয়ায় খুঁজে পাবেন না। ‘Democracy Now’-এ হয়তো পাবেন, কারণ সেখানে আমি লেখালেখি করি। আমেরিকায় এই বিষয়টি নতুন বা অনন্য নয়।
ব্রিটেনের কথাই ধরুন। বর্তমানে ‘The Times Literary Supplement’-এর মতো ব্রিটিশ সাহিত্য জার্নালে আকর্ষণীয় একটি বিতর্ক চলছে। বিতর্কের বিষয়টি হলো - ব্রিটেনের কী কয়েকশো বছর আগে এর উপনিবেশের ‘গণহত্যামূলক’ চরিত্রকে অবশেষে স্বীকার করে নেয়া উচিত? ব্রিটেনের কী এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া উচিত? আপনি এমন প্রশ্ন বিভিন্ন জায়গায় করতে পারেন।
রাষ্ট্র ক্ষমতা, ব্যক্তি ক্ষমতার সমর্থনে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের পশুর পালের মতো এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই অবাক করার। বুদ্ধিজীবীরা নিজেদেরকে ভিন্নমতাবলম্বী, সমালোচক, সাহসী, ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের মত ভাবতে পছন্দ করে। এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা। আপনি ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো লোকের সংখ্যা খুবই কম এবং তারা সাধারণত তাদের কাজের জন্য শাস্তির মুখোমুখি হতো। মূলধারার বুদ্ধিজীবীদের একসময় বলা হতো - রাষ্ট্রীয় শক্তির সমর্থনে এগিয়ে চলা একঝাঁক স্বাধীন মস্তিষ্ক। দূর্ভাগ্যজন হলেও সত্য, এগুলো নতুন কিছু নয়। আপনাকে এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

0 Comments