কোনো বিষয় আয়ত্ত করার একটা এফিশিয়েন্ট টেকনিক হলো রিপিটিশান, পুনরাবৃত্তি। পড়া মুখস্ত করতে, নতুন কোনো অভ্যাস গড়ে তুলতে পুনরাবৃত্তি খুবই কাজে দেয়। পুনরাবৃত্তির ফলে আমাদের মস্তিষ্কে নতুন নিউরাল পাথওয়ে তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে তা শক্তিশালী হয়। পুনরাবৃত্তি আমাদের আচরণ এমনকি চিন্তা করার পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে পারে।
মানুষ সাধারণত কোনো বিষয় সত্য নাকি মিথ্যা তা বিবেচনায় খুব গভীরভাবে চিন্তা করে না। তারা একটা শর্টকাট ফলো করে—আমি কি এই কথা আগে শুনেছি? হ্যাঁ, অসংখ্যবার। তাহলে এটা সত্য। এমনকি বিষয়টি মিথ্যা হলেও মানুষের মধ্যে এই শর্টকাট নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কারণ কি? রিপিটিশান। এই ফেনোমেননকে ইল্যিউসরি ট্রুথ ইফেক্ট (Illusory Truth Effect) বলে। অর্থাৎ, সত্য জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো মিথ্যা বারবার শুনলে-দেখলে মানুষ মিথ্যাকেই সত্য ভাবা শুরু করে।
সোশ্যাল এক্টিভিজমে এই ফেনোমেননকে চমৎকারভাবে কাজে লাগানো যায়। আপনি জনগণের কাছে যে বার্তা পৌঁছাতে চান তার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। বিষয়টা বারবার মানুষের সামনে আনতে হবে, তাদের দেখাতে হবে, বোঝাতে হবে। আর এভাবেই জনগণের চিন্তাজগতে এক সামগ্রিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। একটা উদাহরণ দিই-
পশ্চিমে বামপন্থী এলজিটিভি রাইটস এক্টিভিস্টরা রিপিটিশানকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। সকল ধরনের মিডিয়া—টেলিভিশান, নিউজ, মুভি, টিভি সিরিজ সবগুলোকে ব্যবহার করে এলজিটিভির মত এক অসুস্থ মিথ্যাকে তারা সমাজে নরমালাইজ করেছে। তারা বারবার মানুষকে দেখিয়েছে-বুঝিয়েছে যে এই অসুস্থ ব্যক্তিরাও তোমাদের মত স্বাভাবিক, তাদের এহেন কাজগুলো নরমাল বৈ অন্যকিছু না। তুমি চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম পছন্দ করো, সে স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম পছন্দ করে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাদের এই রিপিটেড ক্যাম্পেইনের ফলাফল সমাজের চিন্তায় আমূল পরিবর্তন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা যায়, ২০০১ সালে প্রায় ৩৫% আমেরিকান সমলিঙ্গের বিবাহকে সমর্থন করত এবং প্রায় ৬০% আমেরিকান এর বিপক্ষে ছিল। কিন্তু ২০১৯-এ এসে সিনারিও একেবারে উল্টে গেল—৬১% আমেরিকান সমলিঙ্গের বিবাহের পক্ষে, ৩১% বিপক্ষে। [১] অন্য আরেক রিপোর্টে (২০১৪) দেখা গিয়েছে, গে এবং লে স বি য়া ন দের প্রতি সমর্থন গত তিন দশকে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সময়ে ট্রা ন্স জে ন্ডা র দের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০%। [২]
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সিনারিও খুব একটা ভিন্ন না। গত কয়েক দশক ধরে কালচাড়াল এলিটরা উপন্যাস, নিউজ, মিডিয়ার মাধ্যমে বারবার বারবার ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। মজিদ-বহীপিরের মতো চরিত্রগুলোর মাধ্যমে ইসলামকে উপস্থাপন করেছে কুৎসিতভাবে। হেফাজতের মোদী বিরোধী আন্দোলনকে বানিয়েছেন “তান্ডব”। [৩] রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়েছে সিস্টেমিক ইসলামোফোবিয়া। দাঁড়ি-টুপি, টাকনুর উপর প্যান্ট ইসলামের এমন বহিঃপ্রকাশকে বানিয়েছেন জ ঙ্গি বা দ, শি বি রপন্থা। আর সাধারণ মানুষ ফলো করেছে শর্টকাট। যা বারবার শুনেছে তাকেই সত্য মনে করেছে।
এত বছরের সোশ্যাল কন্ডিশনিং থেকে মানুষকে বের করে আনা সহজ হবে না। তাদের সামনে তিক্ত সত্যকে তুলে ধরতে হবে। তারা যে রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, বারবার। চিন্তার ছক ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে। কনফ্লিক্টটা যে আদর্শের; ইসলাম এবং সেক্যুলারিজমের তা স্পষ্ট করে তুলতে হবে। এই দু’য়ের সহাবস্থান যে অসম্ভব এবং বিদ্যামান সমস্যাগুলোর একমাত্র সমাধান যে শরিয়াহ তাও স্পষ্ট করতে হবে, বারবার বারবার!
না ৎ জি প্রোপাগাণ্ডা মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবলস ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় গড়ে তুলেছিল এক প্রোপাগাণ্ডা মেশিন। মুভি-ডক্যুমেন্টারির মতো মিডিয়ার মাধ্যমে বারবার চালিয়েছিল ইহুদি বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা। জার্মানদের মধ্যে গড়ে তুলেছিল ইহুদিদের প্রতি এক তিব্র ক্ষোভ। গোয়েবলস বলেছিল, “একটা মিথ্যাকে যথেষ্টবার পুনরাবৃত্তি করলে তা একসময় সত্যে পরিনত হয়”। তবে ভেবে দেখুন সত্যকে অসংখ্যবার পুনরাবৃত্তি করা হলে তার প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে!
সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।
(আল-ইসরা, ১৭ : ৮১)

0 Comments